একাত্তরে নারীর আত্মত্যাগের ইতিহাস এখনও অ-লেখা

0
138

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীঃ একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি যারা দিয়েছিলেন, তাদের আন্তরিকতায় কোনো ত্রুটি ছিল না। তারা আশা করেছিলেন, ওই পরিচয় গৌরব বহন করবে। সে-আশা পুরোপুরি বিফলে গেছে, বীরাঙ্গনা পরিচয় দুঃসহ বোঝায় পরিণত হয়েছিল। উপাধি বহনকারীরা দেখেছেন শিরস্ত্রাণটি কণ্টকশোভিত। ওটি ফেলে দিতে পারলে তারা বাঁচেন। সমাজ তো বটেই, অতি আপনজনও এই মেয়েদের পদে পদে অপমানিত করেছে। কটুবাক্য, অশ্লীল মন্তব্য, হাসিঠাট্টাÑ কোনো কিছু বাদ রাখেনি। অবজ্ঞা, উপেক্ষা তারা সহ্য করতে পারতেন; সার্বক্ষণিক সরব ও নীরব অপমান সহ্য করা কঠিন হয়েছে।
একাত্তরে তারা পালাতে চেয়েছেন। একাত্তরের পরেও লুকিয়ে থাকতে হয়েছে, পালাতেও হয়েছে। পরিবারে আশ্রয় পাননি অনেকে, যারা পেয়েছেন তারা সম্মান পাননি। পালিয়ে শহরে চলে এসেছেন, কেউ চিনবে নাÑ এমন জায়গা খুঁজেছেন; চেয়েছেন আত্মপরিচয় পুরোপুরি লুপ্ত করে দিতে। ‘দেশান্তরিত’ হয়েছেন তারা। ভিখিরি হয়েছেন কেউ; কেউ কাজ নিয়েছেন ভৃত্যের, কেউবা আশ্রয় নিয়েছেন গার্মেন্টসে। কেউ কেউ হয়তো আত্মহত্যাই করেছিলেন, যাদের খবর আমরা রাখি না। নির্যাতনের সময়েও ‘সাহসী’ মেয়েদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন মুক্তির উপায় হিসেবে। যারা পারেননি তাদের বহন করতে হয়েছে অভিশপ্ত জীবনের গøানি।
কেন এমনটা ঘটল? মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের অসামান্য সম্মান এনে দিয়েছিল। সে সম্মান কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না? কারণ হলো এই যে, সম্মানকে আমরা ভাগাভাগি করে নিতে পারিনি। গৌরব কুক্ষিগত করে ফেলতে চেয়েছে অল্প কিছু মানুষ, যারা ক্ষমতাবান ও সুযোগপ্রাপ্ত। কাজটি করার প্রক্রিয়াতে তারা আচার-আচরণ দ্বারা অসম্মানিত করেছে নিজেদের, অসম্মান বয়ে নিয়ে এসেছে গোটা দেশের জন্য।
নির্যাতিত মেয়েরা কিন্তু সম্মান চাননি, গৌরব তাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল না, তারা চেয়েছেন স্বাভাবিক জীবন। সে জীবন তারা পাননি। একাত্তরে পাননি, তারপরেও পাননি। হানাদারেরা সে সুযোগ তাদের দেয়নি। সুযোগ তারাও দেয়নি স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় এসেছে। ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে, রাষ্ট্র ভেঙেছে কিন্তু ব্যবস্থার বদল হয়নি। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আগের মতোই রয়ে গেছে। বরঞ্চ আরও খারাপ হয়েছে। আরও বেশি দুঃসহ হয়ে উঠেছে ব্যবস্থার নিপীড়ন। দু’দিক থেকে ঘটেছে ঘটনা। একদিকে স্বাধীনতা আগের তুলনায় বেশি করে স্বাধীন করে দিয়েছে ক্ষমতাবানদের। তারা সেই স্বাধীনতা ক্রমাগত বৃদ্ধি করেছে। বৃদ্ধি করার অর্থ দাঁড়িয়েছে বঞ্চিতদের বঞ্চিত করা। এদের বৃদ্ধিতে অন্যদের হ্রাস। অন্যদিকে অকল্পনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি যে আশার সৃষ্টি করেছিল, অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। আশাভঙ্গের বেদনা বঞ্চনার দুঃখে নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে।
ব্যবস্থাটা বৈষম্যমূলক। বৈষম্য পুরাতন। একাত্তরের হানাদারেরা সব বাঙালিকেই এক চোখে দেখত। ভাবত, তারা শত্রু। বাঙালিরাও এক হয়ে গিয়েছিল পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে। সত্যি সত্যি এক হয়েছিল কি? না, হয়নি। হওয়া সম্ভব ছিল না। পার্থক্য ছিল হিন্দু-মুসলমানে, ধনী-গরিবে এবং নারী-পুরুষে। মেয়ে-পুরুষ সবাই পালিয়েছে, কিন্তু মেয়েদের পক্ষে পালানোটা কঠিন ছিল। অনেকেরই সন্তান ছিল এবং কেউই জানতেন না কোথায় যাবেন, কোন পথে যাবেন; প্রস্তুতি ছিল না কোনো প্রকারের। উল্টোদিকে পাকিস্তানি সারমেয়রা বিশেষভাবে খুঁজছিল মেয়েদেরকেই। পালের গোদা ব্যাঘ্রের ছদ্মবেশধারী সারমেয় লে. জে. নিয়াজি ছিল হানাদারের জন্য দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা দানকারী। সে তার সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়েছে এবং নিজেও একই কাজ করায় তৎপর থেকেছে। শুনতে পেয়েছি, ইরাকে নাকি আইএসের দুর্বৃত্তরা তবু ধর্ষণের একটি বিধিমালা প্রণয়ন করেছিল; পাকিস্তানি দুর্বৃত্তরা ছিল পুরোপুরি মুক্ত। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তারা ‘মুক্তি’ খুঁজত। আর খুঁজত সেয়ানা মেয়েদের।
নির্যাতিতদের কাহিনিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করার জন্য মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে। সে ইতিহাস লিখিত হচ্ছে, হতেও থাকবে। এদের কাহিনি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। নির্যাতিত সবাই এখন বৃদ্ধা। অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছেন। তারা একে একে চলে যাবেন, তাদের কাহিনিও হারিয়ে যাবে; সে জন্য কাহিনি সংগ্রহ করাটা জরুরি ছিল। এসব কাহিনি আরও অসংখ্য কাহিনির প্রতিচ্ছবি ও মুখপাত্র।
নির্যাতিত মেয়েরা এক রকম নন, প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, কিন্তু নির্যাতন তাদেরকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি একটি মহাকাহিনির অংশ হয়ে গেছে। এই মেয়েদের সঙ্গে আমাদের কোনোদিন দেখা হবে না, কিন্তু তারা সবাই আমাদেরই আপনজন এবং তাদের সবার মুখ মিলেমিশে যেন একটি মুখচ্ছবি, সেটি বাংলাদেশের। তাদের ওপর ওই যে নির্যাতন, বেনামে সেটা ছিল বাংলাদেশের সব মানুষের ওপরই নির্যাতন। পরবর্তী সময়ে তাদেরকে যে অবহেলা ও অপদস্থকরণ, সেটাও আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। ইতিহাসটি অখণ্ড। সেটি প্রবলের অত্যাচারের; দুর্বলের ওপর। প্রবলের পক্ষে আছে রাষ্ট্র ও সমাজ; দুর্বলের পক্ষে কেউ নেই। দুর্বল একা। একাত্তরে দুর্বলেরা এক হয়েছিল, তারা হারিয়ে দিয়েছিল হানাদারদের; কিন্তু ব্যবস্থাটা তো বদলালো না এবং না-বদলানোর সুযোগ নিয়ে নতুন শাসকরা কর্তা হয়ে বসল। বঞ্চিতরা দেখল, তারা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা অসম্ভব। আমরা বলি, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ এবং দুই লাখ নারীর ইজ্জতহানির বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছি। ‘বিনিময়’ কথাটা অন্যায় ও অসংগত। স্বাধীনতা ক্রয় করা হয়নি, এটি বিনিময়যোগ্য কোনো পণ্য নয়, স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। এবং আত্মত্যাগ যারা করেছেন তাদের কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। বলা বাহুল্য, তারা নাম না-জানা লাখ লাখ মানুষের প্রতিনিধি। তারা কেউই বিত্তবান ছিলেন না। অধিকাংশই দরিদ্র। বাইরে কী ঘটছে সেটা তারা জানতেন না। শুনেছেনÑ কে রাজা হবেন, তা নিয়ে ঝগড়া চলছে। তাতে যে উলুখাগড়াদের প্রাণ যাবে, সেটা টের পেয়েছেন তখন, যখন যুদ্ধ এসে একেবারে ঘাড়ের ওপর হামলে পড়েছে। কেউ তাদের সতর্ক করে দেয়নি। বলেনি, কী ঘটতে যাচ্ছে; জানায়নি কী করণীয়। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের চরম ব্যর্থতা এখানে। যুদ্ধ শেষে অধিকাংশই আগের মতো বঞ্চিত রয়ে গেছেন। কারও কারও দুর্ভোগ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী ৫৩ বছরের ইতিহাস তাদের দুর্ভোগ পোহানোর বিরামহীন ইতিহাস বৈ কি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কখনোই পূর্ণাঙ্গ হবে না, যদি ৯ মাসের সঙ্গে পরবর্তী সময়ের দুর্ভোগের কাহিনিকেও যুক্ত না করা যায়। যারা মুক্তিযুদ্ধকে জানতে ও বুঝতে চাইবেন, যুদ্ধ নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্য রচনা করতে উদ্যোগ নেবেন, তাদের অবশ্যই যেতে হবে এসব কাহিনির কাছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেকেই লিখেছেন। আত্মকথনের অভাব নেই; ওই লোকেরা সবাই সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির মানুষ, তাদের কাহিনি আত্মগৌরবের, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ছবি পাওয়া যাবে, কিন্তু বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে যুদ্ধ কী যন্ত্রণা নিয়ে এসেছিল; ৯ মাসে তাদের জীবনের ওপর দিয়ে কোন প্রলয় বয়ে গিয়েছিল, তার খবর পাওয়া যাবে নির্যাতিতদের ইতিহাস অনুসন্ধানে। আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশের অধিকাংশ মানুষের কষ্ট। বিশেষ কষ্ট যুদ্ধবিধ্বস্ত নারীদের। তাদের অপমানে বাংলাদেশের সব মানুষ অপমানিত। অপমানটা একাত্তরে ঘটেছে, চলছে এখনও। আর সেটা করছে কে? করছে রাষ্ট্রীয় সামাজিক ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধ ভাঙতে পারেনি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here