শেখ হাসিনার জন্য ভারত ঠিক কতদূর যেতে রাজি

0
10

গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা যখন দিল্লির উপকণ্ঠে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে এসে নামেন, ভারতের ধারণা ছিল এটা একটা ‘স্টপওভার’ আর তার মেয়াদ বড়জোর ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার জন্যই। সেই ভুল ভাঙতে অবশ্য দিল্লির সময় লাগেনি। ৬ মাস পেরিয়ে আজ ৭ মাসে ঠেকলেও তাকে এখনো পাঠানো সম্ভব হয়নি তৃতীয় কোনো দেশে- এবং রাষ্ট্রের অতিথি হিসেবে তিনি আজও ভারতেই অবস্থান করছেন।

তবে একটা প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে এতদিন কেটে গেলেও তাকে নিয়ে ভারত কী করতে চাইছে আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিন্দুমাত্র কোনো আভাস দিল্লি কিন্তু দেয়নি। ‘অতিথি’ হিসেবে থাকলেও তিনি এখনো কিন্তু ভারতের ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ পাননি।

তাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে অনুমতি দেয়া হচ্ছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি গত মাসেই ভারত কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে নিজেদের দূরত্বও বাড়িয়েছে।

রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে ভারত জানিয়েছে, শেখ হাসিনা যা বলছেন তা পুরোপুরি ‘ইন্ডিভিজুয়াল ক্যাপাসিটি’তে বা তার ব্যক্তিগত পরিসর থেকে বলছেন, এর সাথে ভারতের অবস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই।

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর কিংবা তার মন্ত্রণালয়ও ইদানীং একাধিকবার বলছেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতও সুসম্পর্ক চায়- তবে তাতে কিছু ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ আছে।

এদিকে শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য প্রত্যর্পণ করার অনুরোধ আসার আড়াই মাস পরও কোনো জবাব বাংলাদেশ সরকারকে দেয়া হয়নি।

শেখ হাসিনা নিজে যদিও তার সমর্থকদের উদ্দেশে বাংলাদেশে ফেরার কথাও বলছেন- তবে ভারত বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পুনর্বাসনে সহায়তা করবে এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।

তাহলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে এই মুহূর্তে ভারতের ভাবনা বা পরিকল্পনাটা কী? বা অন্যভাবে বললে, শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভারত ঠিক কতটা যেতে প্রস্তুত?

‘জোর করে কোথাও পাঠানো হবে না’

ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু শেখ হাসিনাকে ভারত কিছুতেই কোনো বিপদের মুখে ঠেলে দেবে না।

সাবেক এই শীর্ষস্থানীয় কূটরীতিবিদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘যদি বলেন, এখন ফিউচার কী? হাসিনার ফিউচার… শি অবভিয়াসলি ইজ নট গোয়িং এনিহোয়্যার (তিনি স্পষ্টতই অন্য কোথাও যাচ্ছেন না), আমার ধারণা।’

‘কারণ অন্য জায়গায় হয়তো (পাঠানোর বিষয়ে) অতটা সুবিধা করতে পারছে না বা ওরকম কিছু। আর ভারতে আছে, ঠিক আছে থাকবে। সে আগেও থেকেছে। ‘৭৫ থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত তো এখানেই ছিল।’

বিদেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা যদি কোনো কারণে ভারতে চলে আসেন, তাদের জোর করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোটা যে কখনোই ভারতের নীতি নয়, সেটাও তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

চক্রবর্তীর কথায়, ‘আমাদের কোনোদিন এরকম পলিসি নেই যে একজন পলিটিক্যাল পারসনকে জোর করে ফেরত দেয়া। দালাই লামাও তো যেমন এখনও ইন্ডিয়াতেই আছেন।’

‘তাই আমরা মনে করি আমাদের এখানে যারা আশ্রয় নিয়ে আসেন, তাদের প্রতি আমাদের একটা…বলতে পারেন সাংস্কৃতিক ব্যাপার বা একটা নীতিগত ব্যাপারও আছে…যে তাদের আমরা জোরজবরদস্তি করে কোথাও পাঠাব না। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এটাই আমার মনে হয়।’

শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে সে দেশের সরকার ভারতকে যে অনুরোধ জানিয়েছে সেটারও কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না তিনি।

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর মতে, যে মামলায় বিচারের জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হচ্ছে সেটা যদি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মনে হয় তাহলে সেই অনুরোধ খারিজ করার বিধান প্রত্যর্পণ চুক্তিতেই আছে এবং সেই যুক্তি প্রয়োগ করেই ভারত এই অনুরোধ নাকচ করে দিতে পারে।

দেখা হচ্ছে শুধু মোদি, ডোভালের সাথেই’

এই দিল্লি শহরেই আবার শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের কার্যালয়- যেখানে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রিজিওনাল ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত।

তবে মা-মেয়ের ইচ্ছে যা-ই হোক, দু’জনের নিয়মিত দেখা হলেও একই সাথে বা একই ছাদের নিচে থাকা কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।

এর কারণটাও সহজ। সায়মা ওয়াজেদ রয়েছেন জাতিসঙ্ঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে, আর শেখ হাসিনা এদেশের অতিথি ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে।

ভারত তার রাজনৈতিক অতিথিকে দেশে জাতিসঙ্ঘের একজন প্রতিনিধির সাথে একসাথে রাখতে পারে না সহজবোধ্য কারণেই।

তবে দিল্লিতে সিনিয়র কূটনৈতিক সাংবাদিক নয়নিমা বসু জানাচ্ছেন, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে রাখা হলেও শেখ হাসিনার সাথে কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝেসাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, ‘এই সাত মাসে আমরা দেখেছি যে- বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেকবার সোশ্যাল মিডিয়াতে স্পিচ দেয়ার একটা অ্যালাওয়েন্স (অনুমতি) দেয়া হয়েছে। এমন নয় যে উনি এখানে চুপ করে বসে আছেন।’

‘ভারত সরকার এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি যে তারা শেখ হাসিনাকে অ্যালাও করেছে যাতে উনি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মস ব্যবহার করতে পারেন…সেটা এক্স হোক, বা ফেসবুক হোক…ওনার নিজের যা বলার আছে তা বাংলাদেশীদের বা বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সাপোর্টারদের উদ্দেশে বলতে!’

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারলেও শেখ হাসিনা কিন্তু পরিচিতজনদের সাথে স্বাভাবিক যে সামাজিক মেলামেশা- সেটা একেবারেই করতে পারছেন না।

নয়নিমা বসুর কথায়, ‘আমরা এটাও জানি যে ওনাকে এখানে একটা সাঙ্ঘাতিক প্রোটেকশনের মধ্যে রাখা হয়েছে এবং খুবই কম সংখ্যক লোক ওনার সাথে দেখা করতে পারেন।’

‘এটাও শোনা গেছে এবং আমরা সোর্সেসের মাধ্যমে জানি যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর ন্যাশনাল সিকিওরিটি অ্যাডভাইসর অজিত ডোভাল- এরা দু’জনই শুধু দেখা করেন ওনার সাথে। তাও সেটা খুব কমই ঘটে, যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো পার্টিকুলার ইস্যু থাকে।’

‘আনলকিং শুরু হলে অবাক হবো না’

এর মাঝে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে না কি রাখা হয়েছে ল্যুটিয়েন্স দিল্লির কোনো বাংলোতেই। এমনকী তিনি মাঝেমাঝে হাঁটাহাঁটিও করছেন দিল্লিতে মর্নিং ওয়াকারদের স্বর্গ লোদি গার্ডেনে!

যদিও লোদি গার্ডেনে রোজকার ভিড় দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, যাকে ঘিরে প্রতিটি পদক্ষেপ কঠোর গোপনীয়তায় মোড়া– তার পক্ষে সেখানে হাঁটাহাঁটি করতে যাওয়া কোনোমতে সম্ভবই নয়!

লন্ডনভিত্তিক লেখক ও বাংলাদেশ গবেষক প্রিয়জিৎ দেবসরকার আবার মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ঘিরে এই গোপনীয়তা আগামী দিনে ধীরে ধীরে উন্মোচন বা ‘আনলকিং’ করা হতে পারে– যদি ভারত সেটার প্রয়োজন অনুভব করে।

তার কথায়, ‘দেখুন, ভারত শেখ হাসিনার সবরকম দায়িত্বই– মানে ওনার সুরক্ষা থেকে শুরু করে যাবতীয় আর যা যা দরকার– তার সবই নিয়েছে।’

‘আর ভারতের গণতন্ত্রের যে পীঠস্থান সংসদ, সেখানে যারা ক্ষমতায় আছেন ও যারা বিপক্ষে, দুটো দলই এক কণ্ঠে স্বীকার করেছে যে শেখ হাসিনা আমাদের অতিথি, উনি যতদিন ইচ্ছে ততদিন ভারতে থাকতে পারেন।’

‘কিন্তু একটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে উগ্রবাদীদের কাছে শেখ হাসিনা একজন চরম টার্গেট। তো ওনার সুরক্ষার দায়িত্ব যখন ভারত নিয়েছে তখন ভারতকে খুব গুরুত্বের সাথে এটা দেখতে হবে যাতে কোনোরকম কোনো আঁচ ওনার ওপর না আসে।’

ঠিক এই কারণেই শেখ হাসিনাকে ঘিরে এই নজিরবিহীন সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন প্রিয়জিৎ দেবসরকার, যদিও পরে এটা পর্যালোচনা করে হতেও পারে বলে তার ধারণা।

‘আমি এখানে আর একটা উদাহরণ দিতে চাই। যেমন কোভিড মহামারীর সময় আমরা লকডাউনের পরে দেখেছিলাম ‘আনলক’– মানে বিধিনিষেধগুলো আস্তে আস্তে ও পর্যায়ক্রমিকভাবে শিথিল করা হয়েছিল।’

‘তো শেখ হাসিনা এখন যেমন তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অডিও ভাষণ দিচ্ছেন দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে, ভবিষ্যতে এটা হয়তো আর একটু ‘আনলক’ হয়ে ওনাকে আমরা অন্য অন্য রূপে বা ভিডিও মাধ্যমেও দেখতে পারি, কে বলতে পারে?’, মন্তব্য প্রিয়জিৎ দেবসরকারের।

এটাও ঘটনা, আজ দীর্ঘ সাত মাস পরেও এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমাদের জানা নেই– শেখ হাসিনা তাহলে আছেন কোথায়?

হয়তো মীরাট সেনানিবাসের ভেতরে কোনো সেফ হাউসে, হয়তো নয়। হয়তো মানেসরে কোনো আধাসামরিক বাহিনীর গেস্ট হাউসে, কিংবা সেটাও নয়!

বস্তুত শেখ হাসিনার সঠিক লোকেশন যে এত লম্বা সময় ধরে গোপন রাখা সম্ভব হয়েছে, এটাও কিন্তু ভারতের জন্য কম সাফল্য নয়!

আওয়ামী লীগ নেত্রী হিসেবে মানুষ কি মেনে নেবে?

শেখ হাসিনা আর কখনও বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে ভাঙাচোরা আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পারবেন কি না, এই প্রশ্নটা এখনো কিন্তু খুবই প্রাসঙ্গিক।

তবে ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন কাজটা অসম্ভব কঠিন তো বটেই– ভারতের পক্ষেও তাকে এক্ষেত্রে সাহায্য করাটা খুব মুশকিল।

ড. দত্ত বিবিসিকে বলছিলেন, ‘ইন্ডিয়া ওনাকে রাখবে। উনি যতদিন এখানে থাকতে চান এবং আমরা যতদিন ফিল করি যে উনি ওখানে ফেরত গেলে নিরাপদ নন, ততদিন ওনাকে রাখা হবে।’

‘কিন্তু রিহ্যাবিলিটেশনের যে একটা কথা উঠছে…আমরা জানি না ভারত সরকার কী ভাবছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের সেরকম একটা চেষ্টা তো অবশ্যই আছে। তবে আমার মনে হয় না সেরকম পরিস্থিতি বাংলাদেশে এখন আর পসিবল!’

শ্রীরাধা দত্ত অবশ্য এটাও মানেন, আওয়ামী লীগ কিছুটা ‘সহানুভূতির হাওয়া’ পেয়েছে ৩২ ধানমন্ডি ভাঙার পরে এবং তার ভাষায় আরো যেসব ‘অকারণ মাইন্ডলেস ডেসট্রাকশন’ বা অর্থহীন ভাঙচুরগুলো হলো তার পরে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তাতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের পথ প্রশস্ত হবে।

তার কথায়, ‘আসলে শেখ হাসিনার ওপরে যে রাগ, যে বিতৃষ্ণা মানুষের– স্বাভাবিকভাবেই এত বছরের একটা ব্যাপার, আমার মনে হয় না এত তাড়াতাড়ি তারা ভুলে যাবে।’

‘আওয়ামী লীগ অবশ্যই একটা ঐতিহাসিক দল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে তারা নিশ্চয়ই একটা বিশেষ জায়গা দখল করে– কিন্তু তাই বলে শেখ হাসিনাকে যে এরপরও সবাই আওয়ামী লীগের নেত্রী বলে মেনে নেবে, সেটা নিয়ে ঘোরতর প্রশ্ন আছে বলেই আমার মনে হচ্ছে,’ মন্তব্য করেন শ্রীরাধা দত্ত।

দিল্লিতে পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য থেকে একটা জিনিস খুব পরিষ্কার– দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনাকে হয়তো ভাষণ দিতে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু তার মানে এই নয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক চালচিত্রে তাকে ভারত আবার হাতে করে বসিয়ে দিতে চাইবে।

বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতি অনুধাবন করেছে বলেই ভারতের এখন সে ইচ্ছাও হয়তো নেই, হয়তো ক্ষমতাও নেই!

সূত্র : বিবিসি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here