জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যার সাথে জড়িত থাকার দায় নিয়ে দিন যতই যাচ্ছে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ততই জোরাল হচ্ছে। এনসিপি, গণ-অধিকার পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ দেশের নতুন-পুরনো ছোট ছোট বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এবং সুশীলসমাজের তরফ থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আওয়াজ উঠছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও এসব দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে দাবি তুলছেন। যদিও বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এ বিষয়ে এখনো নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। বিএনপিসহ অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছলে অন্তর্বর্তী সরকারও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতন ঘটে। ছাত্র-জনতার রোষানল থেকে বাঁচতে তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে নিরাপদ আশ্রয় নেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই সরকারের সব মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ সকল পর্যায়ের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে গণহত্যার বিষয়ে ন্যূনতম অনুশোচনাবোধ সৃষ্টি হয়নি। উল্টো অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতের জন্য জুডিশিয়াল ক্যু, আনসার, পুলিশ, আমলা, পোশাক শ্রমিক, বেসরকারি শিক্ষক ও সাত কলেজসহ অন্তত দেড় শতাধিক বড় বড় আন্দোলনে ইন্ধন যুগিয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব উসকে দেয়ার মিশনে এখনো নেতৃত্ব দিচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যা চালানোর দায়, পরে গুপ্ত হামলা চালানোসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার কারণে গণ-অধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন এবং সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গত ৫ আগস্টের পর থেকেই মাঠে সরব ভূমিকা পালন করছেন। এসব দল ও সংগঠনের নেতারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সভা-সমাবেশ করার মাধ্যমে জনমত গঠন করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। চব্বিশের গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। সম্প্রতি তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টে আমরা দেখেছি পুলিশ শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল। ভারতে থাকুক আর যেখানেই থাকুক, শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচার করতে হবে। আখতার হোসেন বলেন, আর কোনো নয়-ছয় নয়, আইনি প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দলটির রাজনীতি বাংলাদেশে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে।
শনিবার সকালে ঝিনাইদহের একটি রেস্টুরেন্টে জেলার সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় গণ-অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান জাতীয় সংলাপ ডেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইকতেদার আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, এর আগেও ১৯৭৫ সালে একবার আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়। ওই সময় যখন শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করেন তখন আওয়ামী লীগসহ সব দলই বিলুপ্ত হয়। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান যখন বহু দলীয় গণতন্ত্র চালু করেন তখন আওয়ামী লীগ আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ এবং তার দোসররা একটা গণহত্যা চালিয়েছে- এটা সত্য। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী একটি দল। গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের জন্য দাবি উঠছে; তবে চাইলেতো হবে না, আইনি একটা বিষয় আছে। তারপরও বলব, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা বা না করার দায়িত্ব সরকারের। অন্তর্বর্তী সরকার যদি মনে করে আওয়ামী লীগ গণহত্যার সাথে জড়িত তাদের বিচার হওয়া দরকার, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন তাহলে সরকার পদক্ষেপ নিতে পারে। আর দলের নিবন্ধনের একটা বিষয় আছে। এটা নির্বাচন কমিশনের হাতে। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে আওয়ামী লীগ নিবন্ধন বাতিল করার মতো অপরাধ করেছে তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। শেখ হাসিনা এখনো অন্যায়ভাবে, অগণতান্ত্রিকভাবে বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধ নাই। এজন্য দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তবে এ বিষয়ে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সতর্কতার সাথে আওয়ামী লীগের বিচার করতে হবে। এটা ন্যায়ানুগভাবে নিষ্পন্ন হতে হবে। তিনি আরো বলেন, শুধু আইনগতভাবে হলে হবে না, দেশের জনগণের মাঝে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলে ধরে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। আওয়ামী লীগ যে সব সময় রাষ্ট্রবিরোধী, দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করে সেটা জনগণকে জানাতে হবে। তাহলে দেশের মানুষও আওয়ামী লীগের অপকর্ম সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা পাবে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সম্প্রতি তিনি বলেন, প্রথমত এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এক ধরনের ‘ঐকমত্য’ সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ঐকমত্য সৃষ্টি হলে সরকারের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।