ভারতের লোকসভা নির্বাচন আজ থেকে শুরু হয়েছে। সাত দফায় বিশ্বের বৃহৎ এই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে। ভোট শেষে নির্বাচনের ফল ঘোষণা হবে ৪ জুন।
এই নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৬ কোটি ৯০ লক্ষ।ভারতের এবারের ভোটারদের মধ্যে ৪৯ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৪৭ কোটি ১০ লক্ষ নারী।
প্রথমবার ভোট দেবেন, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮-১৯ বছর, এমন ভোটার ১ কোটি ৮০ লক্ষ।
প্রবীণ ভোটার, যাদের বয়স ৮৫ থেকে ৯৯ বছর, এরকম ৮২ লাখ মানুষের নাম আছে ভোটার তালিকায়।
নিরাপত্তা আর ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণেই নানা দফায় ভোট করানো হচ্ছে।
ভারতীয় ভোটাররা কিসের ভিত্তিতে এবার ভোট দেবেন? নরেন্দ্র মোদির তুরুপের তাস কী হবে? নতুন গড়ে তোলা বিশালাকার রাম মন্দির? অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের চিন্তা বা কল্যাণকারী প্রকল্পগুলোর ওপরে ভিত্তি করেই কি ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেবেন? নাকি জাত আর ধর্মের ভিত্তিতে ভোট দেবেন তারা?
রাম মন্দির
মনে করা হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলীয় শহর অযোধ্যায় গড়ে ওঠা হিন্দুদের ভগবান রামের মন্দিরটি এবারের নির্বাচনী দৌড়ে নরেন্দ্র মোদিকে কিছুটা ঐশ্বরিক সহায়তা দিতে পারে।
হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৯২ সালে যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দিয়েছিল, সেই জায়গাতেই গড়ে উঠেছে এই মন্দিরটি। সেই ঘটনার পরে যে দাঙ্গা বেঁধেছিল, নিহত হয়েছিলেন প্রায় দুহাজার মানুষ।
এবছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী ওই মন্দিরটির উদ্বোধন করেন।
সেই অনুষ্ঠান টিভিতে সরাসরি স¤প্রচারিত হয়েছিল। স্কুল, কলেজ আর বেশিরভাগ অফিসও সেদিন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে মানুষ ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা দেখতে পারেন।
অর্থনীতি
ভারতের স্বাধীনতার শতবর্ষ ‘২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ’ হিসাবে গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, তা কি ভোটারদের মনে কোনো দাগ ফেলতে পারবে?
বিশ্বের সবথেকে দ্রæত বাড়তে থাকা অর্থনীতির দেশ ভারত। দেশটির জিডিপি এখন সাড়ে তিন লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার। গত বছর যুক্তরাজ্যকে টপকিয়ে বিশ্বের পঞ্চম সবথেকে বড় অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হয়তো পৌঁছিয়ে যাবে সাত লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারে। আর সেটা সম্ভব হলে জাপান এবং জার্মানিকেও পেরিয়ে যাবে ভারতের অর্থনীতি। তাদের আগে থাকবে মাত্র দুটি দেশ – যুক্তরাষ্ট্র আর চীন।
তবে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফল হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থনৈতিক অসাম্য চোখে পড়ার মতো। বৈশ্বিক জনপ্রতি আয়ের দিক থেকে হিসাব করলে ভারতের স্থান ১৪০ নম্বরে। দেশটির তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষ দিনে ১৭৯ ভারতীয় টাকারও কম আয় করেন। যদিও সরকারি নথিতে বলা হয় যে ‘চরম দারিদ্র্য’ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
কর্মসংস্থান
অনেক ভোটারের মাথাতেই কর্মসংস্থান বিষয়টা থাকবে। তরুণ ভারতীয়দের মধ্যে থেকে ৭০-৮০ লাখ জন প্রতিবছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করে থাকেন। কিন্তু আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ কোনও কাজ জোটাতে পারেন না।
সা¤প্রতিক সরকারি তথ্য অবশ্য বলছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা কমছে এবং শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন যে নতুন সৃষ্টি হওয়া বেশিরভাগ কাজই খুব কম বেতনের চাকরি।
মানুষ যে সঙ্কটে আছেন, তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন দেখা যায় যে লাখ লাখ মানুষ সরকারের গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পে নাম লেখাচ্ছেন। ওই প্রকল্পে কাজ করলে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশো ভারতীয় টাকা পাওয়া যায়। আবার কয়েক হাজার মানুষ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলিতেও কাজ করতে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন।
নির্বাচনি বণ্ড
নির্বাচনের অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনতে যে নির্বাচনি বন্ড ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, স¤প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কারা ওই নির্বাচনী বণ্ড কিনেছে আর কোন দল কত অর্থ পেয়েছে, সেই তথ্যও প্রকাশ করার জন্য সরকারি ব্যাংক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত।
সেই তথ্য সামনে আসতেই দেখা যায় যে নির্বাচনি বণ্ড থেকে সবথেকে লাভবান হয়েছে বিজেপি। দলটি ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যে ১২ শো কোটি ভারতীয় টাকার নির্বাচনি বণ্ড বিক্রি হয়েছিল, তার অর্ধেকই পেয়েছিল বিজেপি।
নানা কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তের মুখে পড়া অনেক সংস্থাই নির্বাচনি বণ্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে অর্থ যুগিয়েছিল বলে একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বিরোধী দলগুলি নির্বাচনী বণ্ডের ব্যবস্থাকে ‘ভারতের ইতিহাসে সবথেকে বড় দুর্নীতি’ বলে আখ্যা দিয়ে অভিযোগ করে যে এজেন্সিগুলিকে দিয়ে তোলাবাজি করানো হয়েছে। তবে সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য সেই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কল্যাণমুখী প্রকল্প
ভারতের কল্যাণমুখী প্রকল্পগুলো পরিমাণ দেখলে বিস্মিত হতে হয়। নরেন্দ্র মোদির সরকার দাবি করে যে তারা প্রায় ৯০ কোটি গরীব মানুষকে সহায়তা দেওয়ার জন্য কয়েক লক্ষ কোটি ভারতীয় টাকা খরচ করেছে। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও কল্যাণমুখী প্রকল্পে প্রচুর অর্থায়ন করে থাকেন।
কিন্তু ওই বিনামূল্যের এক বস্তা চাল বা টয়লেট বানানোর জন্য অর্থ সহায়তা কি একটি দলকে ভোট এনে দেবে? বিশ্লেষকরা অবশ্য বলেন যে এধরণের প্রকল্প হয়তো ভোট পেতে সহায়তা করে, কিন্তু তা একমাত্র ফ্যাক্টর না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।