নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ: সংস্কার কার্যক্রমের পথ ধরে নির্বাচনি রোডম্যাপে উঠবে দেশ * অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ফ্যাসিজমের অনেক প্রেতাত্মা আছে, দ্রত সরাতে হবে -মির্জা ফখরুল
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না-এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাজারো শহিদের রক্তের বিনিময়ে লাখো কোটি জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল। এ সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সবার কাছে হয়তো সাফল্য হিসাবে বিবেচিত নাও হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সবার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। তাই সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। দেশ-বিদেশ থেকে নানারকমের উসকানিতেও জনগণ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেবে না। তবে সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে।
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি তিনি বক্তব্য দেন। এতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নেন।
মাফিয়াচক্রের বেনিফিশিয়ারি অপশক্তি প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে কিংবা রাজনীতির ছদ্মাবরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলেও মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, অন্যায়, অনিয়ম আর অরাজকতার বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণে মাফিয়াচক্রের প্রধান দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশে মাফিয়া শাসন-শোষণের অবসান ঘটেছে। পতিত স্বৈরাচারের পলায়নের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক-মানবিক বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রধান বাধা দূর হয়েছে। তবে বাধা দূর হলেও মাফিয়াচক্রের রেখে যাওয়া ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর হয়নি। এ জঞ্জাল দূর করে ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। তবে মাফিয়াচক্রের প্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেও এ চক্রের বেনিফিশিয়ারি অপশক্তি প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে কিংবা রাজনীতির ছদ্মাবরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম ও প্রধান টার্গেট হওয়া জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কিংবা যে কোনো দেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, রাখবে। তবে কোনো একপর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জবাবদিহিও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এজন্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া উন্নয়ন-গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই ও কার্যকর হয় না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রত্যেক ভোটারের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করে ভোটারদের কাক্সিক্ষত প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
সরকার এজেন্ডা সেটিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে না পারলে গণ-অভুত্থানের সাফল্য ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্রকারী চক্র নানা সুযোগ গ্রহণ করতে পারে বলেও সতর্ক করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, এর কিছু আলামত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেজন্য বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন জনপ্রশাসনের সংস্কার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্ষম ও উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ইতোমধ্যেই বেশকিছু ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
তারেক রহমান প্রত্যাশা করেন, সংস্কার কার্যক্রমের পথ ধরে নির্বাচনি রোডম্যাপে উঠবে দেশ। সুতরাং, আসুন আমরা সবাই কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস, ভালোবাসা অর্জন করি। জনগণের সঙ্গে থাকি। জনগণকে সঙ্গে রাখি।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠন প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, কেউ যদি মনে করেন, একটি উন্নত ও নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরও নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ, শেষ পর্যন্ত জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না। এ কারণেই বিএনপি বারবার জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে। বিএনপি মনে করে, একমাত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশীদারত্ব তৈরি হয়।
গণ-অভ্যুত্থান কিংবা সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানারকম কথা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটি একটি স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য রীতি। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবেন, এটিই স্বাভাবিক। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বিশ্বাস করি, ফৌজদারি অপরাধের বিচার যেমন বিচারিক আদালতে হয়, ঠিক তেমনই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজনৈতিক আচরণের বিচার হয় জনগণের আদালতে।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার যাত্রাপথে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে হয়তো আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধুই রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মনে রাখা প্রয়োজন-রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আচার-আচরণেও গুণগত পরিবর্তন জরুরি। সুতরাং কোনো প্রলোভন কিংবা উসকানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বদানের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখুন। ছাত্র-জনতার কাক্সিক্ষত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার এ যাত্রাপথে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে হয়তো আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরও কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সেই পথ সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসার নয়। সেই পথ হবে ধৈর্য, সহনশীল ও সমঝোতার। রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৩ সালেই বাংলাদেশের পক্ষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। তবে ঘোষিত ৩১ দফাই শেষ কথা নয়। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি-সব ক্ষেত্রেই সংস্কার কার্যক্রম একটি ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির আরও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিমার্জনকেও বিএনপি স্বাগত জানায়।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ফ্যাসিজমের অনেক প্রেতাত্মা অবস্থান করছে। তারা এখনো ছাত্র-জনতার বিজয়কে ব্যর্থ করতে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের দ্রæত চেয়ার থেকে সড়াতে হবে। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একটা সুযোগ পেয়েছি, তা যেন হেলায় হেলায় ফেলে না দিই। সরকারের কাছে আন্দোলনে প্রত্যেক আহত, পঙ্গু ও শহিদের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা নানা সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সরকারকে অনুরোধ করতে চাই, অবিলম্বে ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি সংসদে পাঠাবে। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিএনপি ১৬ বছর আন্দোলন করে এখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের সাবধান-সতর্ক থাকতে হবে। বিজয় এখনো হয়নি। বিজয় ছিনিয়ে নিতে হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্যসচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্যসচিব তানভির আহমেদ রবিনের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আব্দুস সালাম, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন-নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, গাজীপুর জেলার ফজলুল হক মিলন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু, ঢাকা জেলার নিপুণ রায় চৌধুরী, গাজীপুর মহানগরের শওকত হোসেন সরকার, যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজিব আহসান, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইসতিয়াক আজিজ উলফাত, জাসাসের হেলাল খান, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ। আরও উপস্থিত ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কেন্দ্রীয় নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ, আমিরুল ইসলাম খান আলীম, তাইফুল ইসলাম টিপু, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, নাজিমউদ্দিন আলম, মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান প্রমুখ।