আমানত ও খিয়ানত

0
255

আমানতের বিপরীত শব্দ হলো খিয়ানত। কুরআন ও হাদিসে আমানতকে ঈমানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: প্রায়ই তাঁর ভাষণে বলতেন, যার মধ্যে আমানতদারির গুণ নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই এবং যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার গুণ নেই তার মধ্যে দ্বীনদারি নেই। (বাইহাকি) কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমানত যেমন ব্যাপক ও বিস্তর বিষয় তেমনি খিয়ানতও ব্যাপক ও বিস্তর। বুখারি ও মুসলিমে একযোগে বলা হয়েছে, ‘খিয়ানত; মুনাফিকের চারটি নিদর্শনের একটি। তাই কোনো ঈমানদার ব্যক্তি কখনো খিয়ানতকারী হতে পারে না। ঈমানদার হবে আমানতদার, বিশ্বস্ত, আমিন ও সৎবৃত্তি সম্পন্ন।

আমানত শব্দটি বিশ্ব-জাহানের প্রভু অথবা সমাজ কিংবা ব্যক্তি যে আমানত কাউকে সোপর্দ করেছেন তা সবগুলোর অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর এমন যাবতীয় চুক্তি, প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারও এর অন্তর্ভুক্ত হয়, যা মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে অথবা মানুষ ও মানুষের মধ্যে কিংবা জাতি ও জাতির মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। মানুষের প্রতি আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশ তথা আদেশ ও নিষেধ আমানত। কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ আমানত। মানুষের শারীরিক প্রতিটি অঙ্গ আল্লাহর দান ও আমানত। মানুষের মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও যোগ্যতা আল্লাহর দান ও আমানত। তাদের জান-মাল আমানত। নেতৃত্ব ও পদ-পদবি একেকটি আমানত। এগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে আমানত রক্ষা করা হবে। অন্যথায় খিয়ানতকারী হিসেবে অপরাধী হবে।

কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ আমানত : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি এ আমানতকে আকাশসমূহ, পৃথিবী ও পর্বতরাজির ওপর পেশ করি, তারা একে বহন করতে রাজি হয়নি এবং তা থেকে ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষ একে বহন করেছে, নিঃসন্দেহে সে বড় জালেম ও অজ্ঞ। এ আমানতের বোঝা উঠাবার অনিবার্য ফল হচ্ছে এই যে, আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও নারীদেরকে সাজা দেবেন এবং মু’মিন পুরুষ ও নারীদের তাওবাহ কবুল করবেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।’ (সূরা আহযাব : ৭২-৭৩)

তাফসিরে ইবনে কাসির-এ আওফি হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেন, আমানত দ্বারা আনুগত্য বোঝানো হয়েছে। অন্য এক তাফসিরে আমানত অর্থ খিলাফত যা কুরআন মাজিদের দৃষ্টিতে মানুষকে দুনিয়ায় দান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে আনুগত্য ও অবাধ্যতা উভয়ের স্বাধীনতা দান করেছেন এবং স্বাধীনতা দান করার জন্য তাকে অসংখ্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব ক্ষমতা দিয়েছেন। যারা আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের মধ্যে অবস্থান করে তারা স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে তাঁর প্রাধান্যের স্বীকৃতি এবং তাঁর হুকুমের আনুগত্য করবে, নাফরমানির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর আনুগত্যের পথই অবলম্বন করবে; তাদের এমন উচ্চ মর্যাদা দান করা হবে যা তাঁর অন্য সৃষ্টি লাভ করেনি। পক্ষান্তরে যারা অস্বীকার করবে আর তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উত্তোলন করবে তারা সুস্পষ্ট খিয়ানতকারী হিসেবে উত্থিত হবে এবং তাকে খিয়ানতের শাস্তি ভোগ করতে হবে।

বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর রাসূল সা: বলে গেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব তথা আল-কুরআন।’ (সহিহ মুসলিম) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে গেলাম তা যদি তোমরা মেনে চলো তাহলে আমার পরে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।’

মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমানত : মানুষের গুপ্তাঙ্গ আমানত। এভাবে তাদের মাথা, নাক, কান, চোখ, জিহ্বা, পেট ও পা সবই আমানত। এগুলোকে যথার্থ ব্যবহার করা না হলে ওই আমানতের খেয়ানতকারী হিসেবে চিহ্নিত হবে। আল্লাহ তায়ালা সফলকাম মু’মিনের গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে।’ (সূরা মু’মিনুন : ৫)
মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও যোগ্যতা আল্লাহর দান ও আমানত : তাই সুস্থ বিবেকের দাবি হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করা। আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল সা: কর্তৃক প্রদর্শিত পথে নিজেকে পরিচালিত করা।

‘আর (হে নবী)! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমাদের রব বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছিলেন এবং তাদেরকে নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন : আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলেছিল : নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো এ কথা জানতাম না। অথবা না বলে ওঠো শিরকের সূচনা তো আমাদের বাপ-দাদারা আমাদের আগেই করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশে আমাদের জন্ম হয়েছে। তবে কি ভ্রষ্টাচারী লোকেরা যে অপরাধ করেছিল সে জন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করছো?’ (সূরা আরাফ : ১৭২-১৭৩)

সৃষ্টির প্রথম দিনের এ অঙ্গীকার কি আমাদের চেতনা ও স্মৃতিপটে সংরক্ষিত আছে ? যদি না থাকে তবে পদে পদে খিয়ানতের কাজ আমাদের দ্বারা সংঘটিত হতে থাকবে। সৃষ্টির সূচনাকালেই আল্লাহ তায়ালা হজরত আদমক আ:কে পৃথিবীতে পাঠানোর প্রাক্কালে বলেছিলেন, ‘আমরা বললাম, ‘তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌঁছবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোনো ভয় দুঃখ বেদনা। আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী। সেখানে থাকবে চিরকাল।’ (সূরা বাকারা : ৩৮-৩৯)

সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার খিয়ানত হলে, তার মধ্যে আরো অসংখ্য খিয়ানতের প্রবণতা জন্ম নেবে। কুফর, শিরক, মানুষের সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করা, মিথ্যা বলা, অন্যায়ের পক্ষপাতিত্ব করা, অযোগ্য লোকদের হাতে গুরুদায়িত্ব দেয়া, ভুল পরামর্শ দেয়া, মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করা, পারিবারিক একান্ত কথা বাইরে প্রচার করা, মজলিসের আলোচনার বিষয় বাইরে প্রকাশ করা ইত্যাদি সবকিছু আমানতের খিয়ানত করার শামিল।

আমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর এ দায়িত্বটুকু আমার ওপর আমানত। এই আমানতের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। (বুখারি ও মুসলিম) অন্যথায় তা খিয়ানতে পরিণত হবে।

খিয়ানতকারীর সাথেও খিয়ানত করা যাবে না : আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন, যে তোমার সাথে আমানত রেখেছে তার আমানত আদায় করে দাও। যে তোমার সাথে খিয়ানত করেছে তার সাথেও খিয়ানত করো না। (তিরমিজি ও আবু দাউদ) ‘কোনো বান্দাকে যদি আল্লাহ তায়ালা জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করেন, আর সে কল্যাণকামিতার সাথে তাদের তত্ত্বাবধান না করে তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (বুখারি : ৬৭৩১ ও মুসলিম) ‘যদি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনগণের দায়িত্ব লাভ করল এবং তার মৃত্যু হলো এ অবস্থায় যে, সে ছিল খিয়ানতকারী, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি : ৬৭৩২)

জাফর আহমাদ

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here