বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সকল মানুষের রাষ্ট্রকে মেনে নেয়ার যে আস্থা থাকে, সেই আস্থাটা হচ্ছে বিচার বিভাগ ওপরে আস্থা। সেই বিচার বিভাগ যখন আক্রান্ত হয়, যখন কলঙ্কিত হয়, যখন তার কার্যকারিতা প্রায় বিনষ্ট হয়ে যায়। তখন সেই রাষ্ট্রের রূপে জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগকে করায়ত্ত (হাতের মুঠোয়) করতে চায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন বাংলাদেশে তাই চলছে।
শুক্রবার সকালে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ফখরুল বলেন, আমরা বারবার বলে এসেছি বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই। বাংলাদেশ এখন আর সত্যিকারের অর্থে কার্যকরী গণতন্ত্র রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের যতগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই আওয়ামী লীগ সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে। তার সর্বোচ্চ ন্যাক্কারজনক ও জঘন্যতম উদাহরণ আমরা গতকাল দেখেছি। আমরা দেখলাম, সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের যে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত ভয়াবহভাবে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে সেখানকার নির্বাচন ব্যবস্থাটাও ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের মানুষের আস্থা ছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচন কখনো জবরদখল ও কারচুপি হবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটা ধ্বংস করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রতে পরিণত করতে বড় পদক্ষেপ নিল তারা।
তিনি বলেন, এই কথাগুলো অত্যন্ত ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে। বলতে হচ্ছে এই জন্যই, আমরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের কথা বারবার বলি। আমরা যে মানসিকভাবে তৈরি হয়েছি। বাংলাদেশ একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ হবে। সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে থাকবে। মানুষ তার ন্যায়বিচার পাবে। যখন প্রশাসন দ্বারা আক্রান্ত হবে সে কোথায় যাবে? সে তখন যায় বিচার বিভাগে। সে বিচার বিভাগে গিয়ে যদি দেখে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ত হয়েছে, তাহলে সে আর বিচার পাবে না। আজকের সেই জায়গায় আমরা এসে পৌঁছেছি।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে মহাসচিব বলেন, জানি না আজকে আপনারা কতটুকু গুরুত্বের সাথে চিন্তা করছেন। কতটুকু আপনার উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। এ দেশের যারা সিনিয়র আইনজীবী আছেন, যারা সাবেক বিচারপতি প্রধান বিচারপতি আছেন, যারা রাষ্ট্রকে নিয়ে চিন্তা করেন, যারা এ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন -মুক্তিযোদ্ধারা, তারা কিভাবে এই ধরনের ঘটনাকে মেনে নিতে পারে?
তিনি বলেন, ’গণমাধ্যমকে আমরা রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের স্তম্ভ বলি, সেখানেও কিন্তু একই ঘটনা ঘটছে। সেখানেও প্রেসক্লাবকে দখল করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। অদৃশ্য শক্তি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে সব দখল করা হচ্ছে। তাদেরকে চাপ দিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে, যাতে তারা জনগণের দাবিগুলো সামনে তুলে না আনতে পারে।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, গত ১৫ ও ১৬ মার্চ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। এ নির্বাচনকে ঘিরে বিজ্ঞ আইনজীবীদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষেরও ব্যাপক আগ্রহ ছিল। কিন্তু আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করেছি যে- দেশের অন্য সকল নির্বাচনের মতো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সমিতির নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক চরিত্র তার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আইনগতভাবে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলেও নির্বাচনের নাটক সাজিয়ে একতরফাভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অবৈধভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা সবসময় বলে আসছি যে- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের ছত্র-ছায়ায় দেশের কোথাও কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, জনগণের ভোটারাধিকারে বিশ্বাসী নয়, বিগত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় নির্বাচনে ইতোপূর্বে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রমাণ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন। এর আগে ঢাকা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনেও একই ধরনের প্রহসনের নির্বাচন করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, দেশের সাধারণ মানুষের আইনের আশ্রয় নেয়ার শেষ ভরসাস্থল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সমিতিতে তারা নগ্ন হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে।
ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি যে- এই সমিতি নির্বাচনের জন্য বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত সমিতির কার্যকরী কমিটির সভাপতি ও অবৈধ সম্পাদক, যিনি গতবছর সমিতির নির্বাচিত সম্পাদক ব্যারিস্টার মো: রুহুল কুদ্দুসকে (কাজল) নির্বাচিত হওয়ার ৪২ দিন পর পুলিশ ও বহিরাগতদের সহায়তায় সম্পাদকের দফতর জবর-দখল করে নেন, ভোট কারচুপির মাধ্যমে একতরফাভাবে বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রথমে একতরফাভাবে একটি পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন সাব-কমিটি গঠন করে। অথচ সংগঠনের গঠনতন্ত্র মোতাবেক কার্যকরি কমিটির সংখ্যাগরিষ্টের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন সাব-কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। বর্তমান কার্যকরি কমিটিতে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সমর্থিতরা সংখ্যাগরিষ্ট। একপর্যায়ে সাধারণ আইনজীবীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ইতোপূর্বে দলীয় অনুগত নির্বাচন সাব-কমিটির আহ্বায়ককে পরিবর্তন করে সর্বসম্মতিক্রমে সাবেক বিচারপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: মুনসুরুল হক চৌধুরীকে আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়। যদিও তিনি একজন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন তথাপিও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সদস্যরা তার প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলেন। তিনি একজন সৎ, সজ্জন ও দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নও করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের দুই দিন আগে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত সভাপতি ও সম্পাদক পদপ্রার্থী তাকে দিয়ে তাদের অনৈতিক ভোট ডাকাতির নির্বাচনে সম্মত করতে না পারলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন এবং তাদের একান্ত অনুগত একজন দলীয় আইনজীবীকে দিয়ে নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করার আয়োজন করে।
তিনি আরো বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্র মোতাবেক নির্বাচন সাব-কমিটি পুনর্গঠন না করা পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার জন্য জাতীয়তাবাদী আইনজী ঐক্য প্যানেলের প্রার্থীরা যখন দাবি জানান। তখনই আওয়ামী সমর্থিত সভাপতি শতশত পুলিশ নিয়ে গত ১৫ মার্চ, ২০২৩ সমিতির অডিটরিয়ামে প্রবেশ করে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারা আইনজীবীদের উপর আক্রমণ করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের জোরপূর্বক বের করে দেয়। পুলিশি আক্রমণে সমিতির সভাপতি পদপ্রার্থী ও সমিতির সাবেক সাতবারের সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সম্পাদক পদপ্রার্থী ও সমিতির তিনবারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মো: রুহুল কুদ্দুসসহ (কাজল) শতাধিক আইনজীবী আহত হন। নারী আইনজীবীরাও পুলিশি আক্রমণ ও নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। পেশাগত দায়িত্ব পালনরত বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে বেদম প্রহার করে গুরুতর আহত করা হয়। উল্টো ঐক্য প্যানেলের সভাপতি ও সম্পাদক পদপ্রার্থী, বর্তমান কার্যকরী কমিটির ৬ জন সদস্য, সর্বসম্মত নির্বাচন সাব-কমিটির দু’জন সদস্যসহ ১২ জন বিজ্ঞ আইনজীবীর বিরুদ্ধে দু’টি মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের করা হয়েছে। একজন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসবই তাদের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী আইনজীবী ও পুলিশি তাণ্ডবে পরে আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তা সত্ত্বেও নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়েছে। এটা শুধুমাত্র আইনজীবী সমাজেরই নয়, পুরো জাতীর জন্যই কলঙ্কজনক।’
তিনি বলেন, আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোট ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত আওয়ামী লীগের মুখোশ আরেকবার উন্মোচিত হলো। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির সহ দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, চেয়ারপাসনের প্রেস উইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার।