টানটান উত্তেজনায় গতকাল ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ। তবে ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে জোটের ওপর। এতেই ডালপালা মেলতে শুরু করেছে ভাঙাগড়ার সমীকরণ নিয়ে নানা আলোচনা।
চমক দেখিয়ে এককভাবে ১০০ আসনে বিজয়ী হয়েছে কংগ্রেস। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে উত্তর থেকে দক্ষিণ, রায়বেরেলি থেকে ওয়েনাডেতে একসঙ্গে দুটি কেন্দ্র থেকেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নজির গড়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।
অন্য বিরোধী দলগুলোরও গত নির্বাচনের চেয়ে এবার জয়ের পরিসংখ্যান ঊর্ধ্বমুখী। তাই এবার সরকার গঠনের জন্য এনডিএ’র শরিক চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি ও নীতীশ কুমারের জেডিইউর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপিকে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালের ফলের বিপরীতে এবার বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। জোট হিসেবে ২৯৩-এর কিছু বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে এনডিএ। গতকাল রাত পর্যন্ত পাওয়া খবরে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিজয়ী হয়েছে ২৪২ আসনে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল একাই ৩০৩ আসন। এ কারণে এবার নির্ভর করতে হবে জোটের শরিক বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেগু দেশম দলের চন্দ্রবাবু নাইডুর ওপর। আজ বিজেপি নেতৃত্বের এনডিএ’র বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে মোদির প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে। কংগ্রেসও ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক ডেকেছে আজ। রাহুল গান্ধী বলেছেন, তারাও বিবেচনা করবেন সরকার গঠন করা যায় কি না। ইন্ডিয়ার আসন সংখ্যা এখন পর্যন্ত ২৩৩। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদি টুইট করে বলেছেন, তিনি তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করবেন।
এবার লোকসভা ভোটের চমক হলো আমেথি কেন্দ্র থেকে মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির পরাজয়। খোদ রামমন্দির যে শহরে সেই ফৈজাবাদ কেন্দ্রে হেরেছে বিজেপি। ফলাফলের এ সমীকরণ দেখে বিজেপির হিন্দুত্ব রাজনীতি কোনো প্রভাব ফেলেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, এনডিএ সম্মিলিতভাবে জয়ী হয়েছে ২৯৩ আসনে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে বেশি। এ আসনসংখ্যা ধরে রাখতে পারলে তৃতীয়বার মোদির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু এখানেই কাহিনিতে বেধেছে প্যাঁচ। এখন পর্যন্ত যা প্রবণতা, তাতে এনডিএ’র ঝুলিতে ২৯৩ আসনের মধ্যে দুই ‘এন’ যথাক্রমে নাইডু ও নীতীশের দখলে যেতে চলেছে অন্তত ৩০ আসন। এনডিএ’র ঝুলি থেকে সেই ৩০ আসন কমে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবেন মোদি। তাই রাতারাতি দর বেড়ে গেছে নাইডুর। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া শেষ তথ্য বলছে, অন্ধ্রপ্রদেশে এ মুহূর্তে মোট ২৫ আসনের মধ্যে নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এগিয়ে রয়েছে ১৬টিতে। নীতীশের জেডি (ইউ) এগিয়ে রয়েছে ১২ আসনে। দুই ‘এন’-এর দুই দল মিলিয়ে প্রায় ৩০ আসন। দিনের শেষে এ অঙ্কেই থমকে রয়েছে এনডিএ’র জয়ের পাটিগণিত।
লোকসভার সঙ্গেই অন্ধ্রে হয়েছিল বিধানসভা ভোটও। সে ভোটেও বাজিমাত করেছেন নাইডু। পরিস্থিতি এমন যে, দুপুরের আগেই হার স্বীকার করে রাজ্যপালের কাছে দেখা করার সময় চেয়ে বসেছেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস জগন্মোহন রেড্ডি। শোনা যাচ্ছে, তিনি ইস্তফা দিতে চলেছেন। এ পরিস্থিতিতে রাতারাতিই চন্দ্রবাবু শিরোনামে চলে এলেন। এখন প্রশ্ন হলো-নাইডু এনডিএতেই থেকে যাবেন, নাকি অতীতের মতোই শিবির বদলে আবার ‘ইন্ডিয়া’র মঞ্চে দেখা যাবে তাকে?
ফলাফল স্পষ্ট হতেই গতকাল প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ফোন করেছিলেন নাইডুকে। সূত্রের খবর, সেখানে বিজেপির শীর্ষ দুই নেতার সঙ্গে কথা হয় নাইডুর। লোকসভা ভোটে এনডিএ’র ভালো ফলের জন্য নাইডু মোদিকে অভিনন্দনও জানান। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি অংশ মনে করছে, এ ফোনের মধ্য দিয়েই হয়তো জাতীয় রাজনীতিতে আবার শুরু হলো জোট-দৌত্য। অতীতে এ দুই দলের নেতাদেরই একাধিকবার এনডিএ ত্যাগ এবং ফিরে আসার ইতিহাস রয়েছে। এবার তাঁরা কী করেন সেদিকেই নজর সবার।
এবারের নির্বাচনে ১০০ আসন ছুঁইছুঁই কংগ্রেসের। গত দুটি লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার যথেষ্ট ভালো ফল করতে চলেছে শতাব্দীপ্রাচীন এ দলটি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের দখলে ছিল ৪৪ আসন, ২০১৯ সালে ৫২ আসনে জয় পায় তারা। দেশজুড়েই গতকাল সকাল ৮টায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শুরু হয় লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনা। শুরুতে পোস্টাল ব্যালটের গণনা, এরপর ইভিএম গণনা। কিন্তু গণনা শুরুর পর থেকে শেষ পর্যন্ত জোর টক্কর ছিল এনডিএ ও ইন্ডিয়ার মধ্যে। দেশটির ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে মোট সাত দফায় এ ভোট গ্রহণ পর্ব চলে। ১৯ এপ্রিল প্রথম দফার ভোট হয়, শেষ দফার ভোট হয় ১ জুন।
নরেন্দ্র মোদি যদি সরকার গঠন করতে পারেন তাহলে লেখা হবে নতুন ইতিহাস। এর আগে এ কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা প্রয়াত জওহরলাল নেহরু। তবে নেহরুকন্যা ইন্দিরা গান্ধী তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জয় পেলেও একটানা তিনবার দলকে লোকসভার নির্বাচনে জেতাতে পারেননি। সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি মেয়াদের জন্য দায়িত্বে ছিলেন জওহরলাল নেহরু। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত টানা ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নেহরু। ১৯৫৭ সালে নেহরুর নেতৃত্বে ৩৭১ আসনে জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। দেশটির নির্বাচনি ইতিহাসে সেবারই প্রথম কোনো একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে এত বেশিসংখ্যক আসনে জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। ২০১৪ সালের পর ২০১৯ সালের নির্বাচনেও মোদি ম্যাজিকের ওপর ভর করে বিজেপি একাই ২৭২-এর ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়েছিল। কিন্তু এবার কালঘাম ছুটিয়েও সেই টার্গেট ছুঁতে পারল না। ইভিএম খুলতেই এক্সিট পোল ভুল প্রমাণিত হলো। অবশ্য বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কেউই এক্সিট পোলের এ ভবিষ্যদ্বাণী মানতে রাজি হননি। রাহুল গান্ধী, মমতা ব্যানার্জি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রত্যেকেই একে ‘ভুয়া’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।