পক্ষে থাকলে সাধু, বিপক্ষে গেলে শয়তান

0
200

বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের বাইরে অনেকেই চেনে না। তারপরও অনেকেই বাংলাদেশ নিয়ে ভাবেন, মাথা ঘামান যাঁরা এ দেশের মানুষের ভালো চান বা এ অঞ্চলে যাঁদের কূটনৈতিক স্বার্থ আছে। গত ৫২ বছরে এই প্রবণতা পাল্টায়নি।
বিদেশিরা সাধারণত দুটো বিষয় আমলে নেন। এ দেশে কোনো কারণে কোনো অস্থিরতা তৈরি হলে কিংবা দুর্যোগ দেখা দিলে তাঁরা সহমর্মিতা দেখান, সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এটা আমরা দেখেছি ১৯৭০ সাল থেকে নানান দুর্বিপাকে, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার সময়।
আবার রাজনৈতিক দুর্যোগে তাঁদেরকে দেখি মুখ খুলতে। প্রশ্ন হলো, বিদেশিদের এই ভূমিকাকে আমরা কীভাবে দেখব? এটা ভালো না মন্দ? এটা কি সহানুভূতি, না হস্তক্ষেপ? এটা নির্ভর করে আমরা টেবিলের কোন পাশে বসে দেখছি। আমরা কি তাদের এহেন ভূমিকার সুবিধা নিচ্ছি, নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি? সুবিধাভোগীর কাছে তাদের ‘হস্তক্ষেপ’ ইতিবাচক, ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্তের কাছে তা নেতিবাচক বা অনভিপ্রেত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছি। এমনও বলা হয়, তারা সাহায্য না করলে বাংলাদেশ ওই সময় স্বাধীন হতো না। আমরা আমাদের সহযোগীদের মিত্র মনে করি। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি তাদের। একাত্তরে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে। তারা নিজেদের মনে করে ভিকটিম। তারা বলে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের ফলে পাকিস্তান ভেঙে গেছে। কোনটা সত্য? এটা নির্ভর করে আপনি কোন পক্ষের চোখ দিয়ে দেখছেন।
জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগছে। শান্তিপূর্ণভাবে ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার হাতবদল হয় না। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। বেশ কিছু জায়গায় কারচুপি ও কারসাজি করে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া জয় পায়। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৮ সালে। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর পর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর ফল হয়েছিল ভয়াবহ।
এরপর দেশে চালু হয় দ্বিদলীয় রাজনীতি। রাজনীতির মেরুকরণ এমন হয় যে তাদের মধ্যে সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই চলে আসছে রাজনৈতিক সংকট। নব্বইয়ের দশকজুড়ে বিদেশ থেকে রেফারি এনে দুই পক্ষের মধ্যে আপসের নানান চেষ্টা হয়েছে। জাতিসংঘও উদ্যোগ নিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যকার দূরত্ব দূর হয়নি।
বছরখানেক পর নির্বাচন হবে। দলীয় রাজনীতির ধর্মই হলো ক্ষমতায় যাওয়া। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পরিষ্কার বলেছিলেন, তাঁর দল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশন নয়। তিনি ক্ষমতায় যেতে চান। ক্ষমতায় গিয়ে মানুষের সেবা করতে চান। এখন অনেককে তাদের প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলতে শুনি আরে, ওরা তো মানুষের কথা ভাবে না, ক্ষমতার রাজনীতি করে! এটা বলে এ জন্য যে তারা শুধু ক্ষমতাটাই দেখে ও উপভোগ করে, আর নিজেদের সেবা করে বেড়ায়।
আশির দশকে এইচ এম এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে দুই পক্ষ এককাট্টা হয়েছিল। দুই পক্ষই অন্তর্র্বতী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছিল। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আমরা এভাবে চারটি নির্বাচন হতে দেখেছি। প্রতিবার দেখা গেছে, ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের হটিয়ে বিরোধী দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল নানাভাবে অন্তর্র্বতী সরকারব্যবস্থাকে বিকৃত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় ভোটাররা তাদের শক্তি দেখাতে পেরেছে। ২০০৮ সালের পর এই শক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল বিএনপি মেনে নিতে চায়নি। ঢাকার হোটেল সোনারগাঁয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন এঁরা কী জানেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিদেশিদের পর্যবেক্ষণকে স্বাগত জানিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকাশ্যে বলেছেন, ভারতকে গ্যাস দিতে রাজি না হওয়ায় তাদেরকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এক-এগারোর সময় বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিএনপি এতে খুব নাখোশ ছিল। কারণ, তাদের সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব এক-এগারোর সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে দায়মুক্তি দিয়েছিল। এ সবই নিকট অতীতের কথা, আমাদের সবার জানা। একটা বিষয় খুব পরিষ্কার। বিদেশিদের কথা আমার পক্ষে গেলে জায়েজ, বিপক্ষে গেলে নাজায়েজ।
বিদেশিদের কোনো জরিপে বা সংবাদমাধ্যমে যখন আমাদের প্রশংসা করা হয়, আমরা আহ্লাদে আটখানা হই। তখন এসব খবর খুব জোরেশোরে প্রচার করা হয়। একই সূত্র থেকে যদি বলে এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তখন আমাদের গার্জেনরা বলেন, ‘আমরা এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করি।’ মুহূর্তেই বিদেশি ফেরেশতারা শয়তান হয়ে যায়।
ফুটবল খেলায় রেফারির দরকার হয়। তিনি দরকারমতো সিদ্ধান্ত বা শাস্তি দেন। তারপরও হেরে যাওয়া দল রেফারির খুঁত ধরে। সেখানে প্রতিকারের একটা সুযোগ থাকে, আপিল করা যায়। ফিফা হচ্ছে শেষ ভরসা।
আমাদের রাজনৈতিক খেলায় রেফারি হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আমরা দেখেছি, অন্তর্র্বতী সরকারের অধীনে কমিশন যেভাবে কাজ করে, দলীয় সরকারের অধীনে সে রকম পারে না বা করতে দেওয়া হয় না। মনে আছে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন শান্তিপূর্ণভাবে জয়ীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। সেটাই প্রথম, সেটাই শেষ। তখন বিদেশি পর্যবেক্ষকের দরকার হয়নি।
এখন পশ্চাৎপদ অনেক দেশেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিদেশি পর্যবেক্ষক আনা হয়। আমি নিজে নেপালের তিনিটি সাধারণ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করার সময় অনেক কিছু দেখেছি ও শিখেছি। রাজতন্ত্র উৎখাতের পর সেখানে যতবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, প্রতিবারই হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। আমাদের নির্বাচন কমিশনের কর্তারা অন্য দেশে নির্বাচন দেখতে যান। নেপালেও যান। তাঁরা কী দেখেন কী শেখেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।
ঘরের ঝগড়া নিজেরা মেটাতে না পারলে কোনো প্রতিবেশী বা মুরব্বির পরামর্শ নেওয়ার চল আছে আমাদের সমাজে। এই সালিস প্রথা টিকে আছে যুগ যুগ ধরে। এরপরও অনেক গোঁয়ার-গোবিন্দ জেদ ধরেÑসালিস মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার। বিদেশিরা ১৯৯৬ থেকে অনেকবার এ দেশে এসেছে সালিস করতে। কিন্তু আমরা মানিনি। শেষমেশ আমরা সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থায় কোনো দল পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এটাই ছিল এই ব্যবস্থার ইতিবাচক দিক। ওই দিন ভোটাররাই রাজা। তাঁরা গণেশ উল্টে দেন।
দীর্ঘ মেয়াদে কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থার থেকে মুক্ত হতে ফিলিপাইন ও কোরিয়া প্রজাতন্ত্র সংবিধানে একটি ধারা ঢুকিয়েছে কেউ এক মেয়াদের বেশি সরকারপ্রধান থাকতে পারবেন না। আমি ক্ষমতায় না থাকলে দেশের সর্বনাশ হবে, জনগণ এতিম হয়ে পড়বে, আমি ছাড়া দেশকে কেউ ভালোবাসে না ওই দেশের রাজনীতিবিদেরা এখন আর এটা মনে করেন না।
বছরখানেক পর নির্বাচন হবে। দলীয় রাজনীতির ধর্মই হলো ক্ষমতায় যাওয়া। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পরিষ্কার বলেছিলেন, তাঁর দল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশন নয়। তিনি ক্ষমতায় যেতে চান। ক্ষমতায় গিয়ে মানুষের সেবা করতে চান। এখন অনেককে তাদের প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলতে শুনি আরে, ওরা তো মানুষের কথা ভাবে না, ক্ষমতার রাজনীতি করে! এটা বলে এ জন্য যে তারা শুধু ক্ষমতাটাই দেখে ও উপভোগ করে, আর নিজেদের সেবা করে বেড়ায়।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। বিদেশিরা বেশ নড়াচড়া করছেন। তাঁরা বলেছেন, উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তাঁরা দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান। কথা হলো, এটা বিদেশিদের বলতে হয় কেন? আমরা কি পারি না একটা ভালো নির্বাচন করতে, যেমনটি করছে নেপাল?
বিদেশিদের কথা কানে মধুবর্ষণ করে যখন তা পক্ষে যায়, আর বিষ ঢেলে দেয়, যখন তা বিপক্ষে যায়। এ হলো ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের’ শানে নজুল। তবে যত দিন গড়াবে, এই প্রবণতা আরও বাড়বে।


মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here