ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর মতো পশ্চিমবঙ্গেও কার্যত বিপর্যস্ত বিজেপি। রাজ্যটির ৪২ লোকসভা আসনের মধ্যে মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেস ৩০ আসনে জয় পেয়েছে, বিজেপি ১১ আসনে, ১টি আসনে জয় পেয়েছে কংগ্রেস।
সা¤প্রতিক বুথফেরত জরিপে বলা হয়েছিল- শাসক দল তৃণমূলের চেয়ে বেশি আসন পেতে চলেছে বিজেপি। কিন্তু কার্যক্ষেত্র দেখা গেল গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে যে ১৮টি আসনে বিজেপি জয়ী হয়েছিল, সেই আসনগুলোও এবার নিজেদের দখলে রাখতে পারল না তারা। অন্যদিকে গত নির্বাচনে এ রাজ্য থেকে ২২ আসনে জয় পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস, সেখান থেকে তাদের আসন সংখ্যা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার।
এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও মমতা ব্যানার্জির ভাতিজা অভিষেক ব্যানার্জি। ডায়মন্ড হারবার আসনে সর্বাধিক ৭ লাখেরও বেশি ভোটে বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ দাসকে হারিয়েছেন অভিষেক। এ আসনে ভোট ১০ লাখ ৪৮ হাজার ২৩০, অভিজিতের প্রাপ্ত ভোট ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০। এ ছাড়াও জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন তৃণমূলের দীপক অধিকারী ওরফে দেব (ঘাটাল), শতাব্দী রায় (বীরভূম), শত্রুঘ্ন সিনহা (আসানসোল), অভিনেত্রী রচনা ব্যানার্জি (হুগলি), অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ (যাদবপুর) ও মহুয়া মৈত্র (কৃষ্ণনগর)। বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর (বনগাঁ), কলকাতা হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলী (তমলুক)। ভারতের দুই সাবেক ক্রিকেটার তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠান (বহরমপুর) এবং কীর্তি আজাদ (বর্ধমান-দুর্গাপুর) উভয়েই জয়ী হয়েছেন। কলকাতার দুটি আসনেও জয় পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থীরা। কলকাতা উত্তর আসনে জয়ী হয়েছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা দক্ষিণ আসনে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের প্রার্থী মালা রায়।
তবে কঠিন লড়াইয়ের পরও হারতে হলো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক (কোচবিহার), বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার (বালুরঘাট), বিজেপি প্রার্থী এস এস আলুওয়ালিয়া (আসানসোল), বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায় (হুগলি), বিজেপির দিলীপ ঘোষ (বর্ধমান-দুর্গাপুর), রাজ্যটির কংগ্রেস সভাপতি ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কংগ্রেসের প্রার্থী অধীর রঞ্জন চৌধুরীর (বহরমপুর) মতো হেভিওয়েট প্রার্থীদের। দলের এই সাফল্যের রাজ্যজুড়ে জয়ের উৎসবে মেতে ওঠে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা। সবুজ আবির নিয়ে খেলার পাশাপাশি চলে মিষ্টিমুখ। কালীঘাটে দলের প্রধান মমতা ব্যানার্জির বাড়ির সামনে উচ্ছ¡াসে মেতে ওঠেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। এ রাজ্যে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং গোটা ভারতে ইন্ডিয়া জোটের এ সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করেন তৃণমূল প্রধান মমতা ব্যানার্জি। সন্ধ্যায় কালীঘাটে সংবাদ সম্মেলনে বিজেপি ও এনডিএ জোটের তীব্র সমালোচনা করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘আমি খুব খুশি যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। মোদি তোমার ভোট অন্য কোথাও যায়নি। তোমার ম্যাজিক শেষ। তোমাকে পদত্যাগ করতে হবে।’
মমতার বক্তব্য, ‘উনি (নরেন্দ্র মোদি) বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন ওনার অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া উচিত, কারণ উনি বলেছিলেন এবার ৪০০ পার। কিন্তু আমি বলেছিলাম ২০০ পার হবে কি না দেখে রাখুন। কারণ কিছুটা হাতে রাখতে হয়। সেসময় অনেকেই আমার কথা বিশ্বাস করেননি। এখন তাদের তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) আর জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) এর পায়ে ধরতে হচ্ছে। এরা ইন্ডিয়া জোটকে ভাঙন ধরাতে পারবে না।’ নৈতিক দায় মাথায় নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ইস্তফা ও দাবি করেছেন মমতা। তার অভিমত, ‘যদি বিজেপি সরকারে না থাকত তাহলে আরও কম আসন পেত।’
মমতা এও স্মরণ করিয়ে দেন, ‘এনডিএ জোটের দুই- তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তাই সংসদে যে কোনো আইন পাস করাতে পারবে না। ইডি, সিবিআই অত্যাচার করলে আমরা টিম ইন্ডিয়া পুরোপুরি চেপে ধরব।’
এদিন সন্ধ্যায় ভাতিজা অভিষেক ব্যানার্জিকে পাশে বসিয়ে মমতার অভিযোগ, ‘এখনো চার-পাঁচ জায়গায় তৃণমূল প্রার্থীরা জেতার পরও বিজেপির অবজারভাররা জয়ের সনদ দিচ্ছে না। বিজেপিকে জয়ী ঘোষণা করার জন্য কাঁথিতে জেতার পরও বিজেপির অবজারভার জয়ের সনদ আটকে রেখে দিয়েছে।’
বিজেপির এ ভরাডুবিতে প্রশ্ন উঠেছে কী কারণে বাংলায় মোদি ম্যাজিক কাজ করল না? কেন বেশিরভাগ এক্সিট পোলের হিসাব-নিকাশই উল্টেপাল্টে গেল? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলায় তৃণমূলের জয়ের মূল কারণ ল²ীর ভান্ডার প্রকল্পের রুপি দ্বিগুণ করে দেওয়া। লোকসভা ভোটের ঠিক আগে গত ৮ ফেব্রæয়ারি এ বছরের রাজ্য বাজেটে ল²ীর ভান্ডারের অনুদান ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১০০০ রুপি করা হয়। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের ক্ষেত্রে ১০০০ রুপি বাড়িয়ে হয় ১২০০ রুপি। এর প্রভাব সরাসরি ভোট বাক্সে পড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়াও মমতাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ ছিল কেন্দ্রের বঞ্চনা। একশ দিনের কাজের রুপি আটকে রাখা, বকেয়া প্রাপ্য আটকে রাখা, সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্সের মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে অপব্যবহার করার ইস্যুগুলোও ভোটাররা ভালোভাবে নেয়নি। তাছাড়াও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, রাম মন্দিরের উদ্বোধন, তিন তালাক প্রথা প্রত্যাহারের মতো কেন্দ্রীয় সরকারের যে সব কর্মকান্ড তাও ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারেনি। এ ছাড়াও প্রার্থীদের ঘন ঘন দল পরিবর্তন, জয়ী আসনের বদলে প্রার্থীকে অন্য আসনে দাঁড় করানোর মতো বিষয়গুলোও বিজেপির হারের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।