পাকিস্তান ক্ষমা না চাইলে সুসম্পর্ক হবে না

0
71

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ, রাত দশটা। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন। বারোজনের একটি পরিবার প্ল্যাটফরমে পৌঁছে দেখল একটু আগেই উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনটা চলে গেছে। ওটাই ছিল শেষ ট্রেন, আর কোনো ট্রেন নেই। পরিবারটি বিপদে পড়ল। ট্রেন নেই, ঘরে ফিরে যাওয়ার মতো কোনো যানবাহনও স্টেশনে নেই। স্টেশনে যারা ছিলেন, ছোটাছুটি করে যে যেদিকে পারেন পালিয়ে যাচ্ছেন। শহরে পাকিস্তান আর্মি নেমেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সবাই আতঙ্কিত।
স্টেশন মাস্টার বারোজনের পরিবারটিকে একটি ওয়েটিং রুম খুলে দিয়ে বললেন সেখানেই রাতটা কাটিয়ে দিতে। তিনি সাবধান করে দিয়ে বললেন ‘কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। খবর পেলাম আর্মি এদিকেই আসছে। যাই হোক, আমি আমার অফিস ঘরেই থাকব।’
ভয়াল রাতে কমলাপুরে
এরপরেই শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি হানাদারদের তাণ্ডব। ট্রাক থেকে নেমেই সৈন্যরা যাকে যেখানে পেল সেখানেই গুলি করে মারল। স্টেশন মাস্টারও রেহাই পেলেন না। তাকে তার অফিস ঘরেই গুলি করে হত্যা করা হলো। বারোজনের পরিবারটি আলো নিভিয়ে ওয়েটিং রুমে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকায় তারা বেঁচে গেল। কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল কিভাবে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে।
২৭ মার্চ সকাল ৮টায় কারফিউ উঠে যাওয়া পর্যন্ত পরিবারটি ওয়েটিং রুমে আটকে ছিল। তাদেরই একজন শাহানা পারভীন ‘ভয়াল রাতে কমলাপুর স্টেশনে’ শীর্ষক এক নিবন্ধে ২৫-২৬ মার্চের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রাঙ্গণ’-এর চতুর্থ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় (জানুয়ারি-মার্চ ২০০৮)।
শাহানা পারভীন তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, তারা প্রায় ৩৪ ঘণ্টা ওয়েটিং রুমের ভেতরে অবরুদ্ধ ছিলেন। এ সময় এক মিনিটের জন্যও গোলাগুলি থামেনি। গোলাগুলির শব্দের সঙ্গে শোনা গেছে মানুষের আর্তচিৎকার। স্টেশনের প্ল্যাটফরমে রক্তের স্রোত। মৃতদেহগুলোর পা ধরে টেনে নিয়ে মালগাড়ির ওয়াগনে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। সব দোকানপাট ভেঙে তছনছ করা হয়। প্ল্যাটফরমের সবখানে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, বালি দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
হানাদারদের নৃশংসতা
কমলাপুর স্টেশনে দুই রাত একদিনে বহু প্রাণহানির কথা শাহানা পারভীন বললেও কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন সে তথ্য দিতে পারেননি। অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকে সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে যা শুনেছি তা ভয়াবহ। কমলাপুর স্টেশন থেকে উত্তরে মুগদা পর্যন্ত রেললাইনের দুই পাশে এবং দক্ষিণে গোপীবাগ রেলগেট পর্যন্ত শত শত বস্তি ও কাঁচাঘর ছিল। দক্ষিণ কমলাপুরেও বড় বস্তি ছিল। এগুলোর একটিও হানাদারদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি। পাকিস্তানি সৈন্যরা সবকটি বস্তি ও কাঁচাঘরে আগুন দিয়েছে। ঘরের ভেতরে যারা ছিল, তারা পুড়ে মরেছে, যারা বাইরে আসার চেষ্টা করেছিল, তাদের গুলি করে মারা হয়েছে।
কমলাপুর স্টেশনের ছাদ থেকে সৈন্যরা ভারী মেশিনগান দিয়ে গোপীবাগ রেলগেটের দিকে অবিরাম গুলি ছুড়েছে, এতেও বহু লোক মারা যান। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে যাওয়ার পর গোপীবাগ রেলগেট সংলগ্ন জামে মসজিদের ভেতরে ও বাইরে অনেক গুলিবিদ্ধ লাশ দেখা গেছে। হানাদাররা মসজিদকেও রেহাই দেয়নি।
কমলাপুর স্টেশন এবং এর আশপাশের বস্তি এলাকায় সেই দুই রাত একদিনে কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন? কমলাপুর, মুগদা ও গোপীবাগ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা যারা সে সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন, যারা প্রত্যক্ষদর্শী, তারা সবাই একমত যে, সে সময় ওই এলাকায় অন্তত পাঁচ হাজার লোক নিহত হন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে যে গণহত্যা শুরু করেছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এ অপারেশন দুই দিন ধরে চলেছিল সমগ্র ঢাকা মহানগরীতে। কমলাপুর স্টেশন ছাড়াও এ অপারেশনের প্রথম টার্গেট ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পিলখানা, রাজারবাগে প্রতিরোধ
উল্লিখিত তিনটি স্থানে একই সময়ে হামলা শুরু করা হয়। তবে রাজারবাগে পুলিশ বাহিনী ও পিলখানায় ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং অনেকক্ষণ হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। গুলি বিনিময়ে বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সৈনিক শহিদ হন। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিও কম ছিল না। রাজারবাগে এক পর্যায়ে বাঙালি পুলিশরা পিছু হটে গেলে হানাদাররা পুলিশের সবকটি ব্যারাক ও ছাউনি পুড়িয়ে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একইসঙ্গে ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসিক ভবনে আক্রমণ শুরু হয়। জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল এবং শিক্ষকদের কয়েকটি আবাসিক ভবন ছিল তাদের প্রধান টার্গেট। ছাত্রাবাসগুলোতে যারা অবস্থান করছিলেন, তাদের কেউ বাঁচতে পারেননি। কিছুসংখ্যক শিক্ষককে তাদের বাড়িতে গিয়ে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়। তাদের একজন অধ্যাপক জি সি দেব। ধারণা করা যায়, হানাদাররা শিক্ষকদের তালিকা নিয়ে এসেছিল এবং এ তালিকা তৈরি করেছিল পাকিস্তানিদের এদেশীয় এজেন্টরা। মধুর ক্যান্টিনের মধুদাও এ তালিকায় ছিলেন। তার বাড়িতে গিয়ে তাকে সৈন্যরা হত্যা করে। নিউমার্কেটের পশ্চিম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের দোতলা ছাত্রাবাস ছিল। সেখানেও পঁচিশের রাতেই সৈন্যরা প্রতিটি কক্ষে ঢুকে ছাত্রদের গুলি করে মারে।
পঁচিশে মার্চ রাতে ও পরদিন সকালে ঢাকা শহরে যত বস্তি ও কাঁচাবাজার ছিল, সবকটিতে আগুন দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। বস্তিবাসী আগুনে পুড়ে মরেছে অথবা ঘর থেকে বের হলে গুলি খেয়েছে। কাঁচাবাজারগুলোতে রাতেও কিছু লোক থাকে। আগুনে তারাও দগ্ধ হয়েছে পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে। পঁচিশে মার্চ ক্র্যাকডাউনের সময় বহু লোক রাস্তায় ছিলেন; রিকশায় অথবা যানবাহনে অথবা হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। তাদের মধ্যে কমসংখ্যকই বাঁচতে পেরেছেন।
ওরা কত মানুষ মেরেছে
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল ৮টা পর্যন্ত ৩২ ঘণ্টায় হানাদার বাহিনী ঢাকা নগরীতে কত মানুষকে হত্যা করেছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন হিসাব পাওয়া যায়। দখলদার পাকিস্তানি সরকার কোনো হিসাব দেয়নি, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারও এ নিয়ে কোনো হিসাব বা জরিপ করেছে বলে জানি না।
তবে ভয়াবহ ওই দুদিনে ঢাকা নগরীতে নিহত মানুষের সংখ্যা সম্পর্কে আমার নিজের পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও জরিপ রয়েছে। ওই সময়ে আমি ঢাকা শহরের গোপীবাগে নিজ বাসভবনে ছিলাম। কমলাপুর গোপীবাগের কাছেই। কাজেই নিজের পর্যবেক্ষণ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মনে করি কমলাপুর, মুগদা ও গোপীবাগ এলাকায় ২৫-২৬ মার্চে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। ঢাকার একটি এলাকাতেই যদি পাঁচ হাজার প্রাণহানি হয়, তাহলে পুরো নগরীতে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেই সময়ে? এক্ষেত্রে অনুমাননির্ভর হিসাবনিকাশ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
কমলাপুর স্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাজারবাগ এবং বিভিন্ন রাস্তা ছাড়াও বস্তিগুলোতেই প্রাণহানি বেশি হয়েছিল। বেশিরভাগ বস্তি ও বাজার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রয়াত ট্রাস্টি স্থপতি রবিউল হুসাইন গণহত্যা নিয়ে কিছু কাজ করেছিলেন। তিনি এবং আরও অনেকে আমাকে বলেছিলেন, ২৫-২৬ মার্চ ঢাকায় গণহত্যায় প্রাণহানির সংখ্যা কমপক্ষে ২০ হাজার। ৩২ ঘণ্টার বিরতিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা বিবেচনায় নিয়ে আমিও নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ঢাকায় সেই দুদিনে প্রাণহানি ২০ হাজারের কম হবে না। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা যদি পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করতে পারেন, তাহলে স্বাগত জানাব। ঢাকায় মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছাড়াও একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণ পর্যন্ত হানাদার বাহিনী সারা দেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল। সরকারিভাবে একাত্তরে গণহত্যার মোট প্রাণহানি ৩০ লাখ বলা হয়েছে এবং সেটাই স্বীকৃত। গণহত্যা ছাড়াও পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় সহচররা নারী নির্যাতনের মতো ঘৃণ্য অপরাধও করেছে।
পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতেই হবে
পাকিস্তানিরা পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা নিচু করে এদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বমানচিত্রে স্থান পেয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ হয়ে ৫৩ বছর হতে চলেছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার একাত্তরে গণহত্যার জন্য এখনো বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি। পাকিস্তান যে অপরাধ এখানে করে গেছে, বাংলাদেশের জনগণ তা ভুলে যায়নি, কখনো ভুলবে না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা-‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। কিন্তু এ নীতি পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পাকিস্তান যতদিন ক্ষমা না চাইবে, ততদিন সেই দেশ আমাদের ‘শত্রুরাষ্ট্র’ হিসাবেই থাকবে। দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও সুসম্পর্ক কখনোই হবে না, সুসম্পর্ক রাখার প্রশ্নই আসে না।
লেখকঃ চপল বাশার, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here