ঢাকা : ফের আলোচনায় নাথান বম। পাহাড়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন হিন্দাল শারক্বীয়ার জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি আলোচনায় আসে গত দুই বছর আগে। হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয় ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বা ‘কেএনএফ’। এই ‘কেএনএফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম। গোয়েন্দারা বলছেন, সীমান্তের ওপারে একটি গ্রামে অবস্থান করেই কেএনএফের সবকিছু সমন্বয় করছে নাথান বম। দেশের বম স¤প্রদায়ের অনেক সদস্যকেই নাথান কেএনএফ-এ ভিড়িয়েছে। মাঝে মাঝেই নাথান মিয়ানমার এবং নেদারল্যান্ডসে যাতায়াত করেন বলে খবর পেয়েছেন তারা। সা¤প্রতিক কুকি-চিন এর ভয়ংকর তৎপরতার পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক শীর্ষ ব্যক্তি।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল মাহবুব আলম বলেন, নাথানের অবস্থান শনাক্ত করতে আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আজ কেএনএফ-এর প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বমকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেখা যাক তার কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি না! তবে এর জন্য আমরা ইন্টারপোলের সহায়তাও নিব।
একাধিক সূত্র বলছে, কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সঙ্গে ২০২০ সালের শেষের দিকে জামাতুল আনসারের তৎকালীন আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদের সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কেএনএফ প্রশিক্ষণ দেবে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা করে দেওয়া হয় কেএনএফকে। এমনকি প্রশিক্ষণার্থী এবং কেএনএফ-এর প্রশিক্ষকদের খাবার খরচ বহন করে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। যে চুক্তির মাধ্যমে এই নব্য জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আশ্রয় দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথাও ওই চুক্তিতে বলা হয়। ওই অর্থের বিনিময়ে নব্য জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যরা সেখানে অবস্থান করছিল, প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। তারা সেখানে খাবারসহ সব ধরনের সাপোর্টও পেয়ে আসছিল।
যেখান থেকে উত্থান : পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বম স¤প্রদায়ের লোকসংখ্যা সাকুল্যে ৫-৬ হাজার। পার্বত্য এলাকার বান্দরবান জেলায় মূলত এই স¤প্রদায়ের মানুষের বাস। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী স¤প্রদায়ের মধ্যে যারা পিছিয়ে পড়া, বমরা তাদের মধ্যে অন্যতম। এই বমদের মধ্যে এক ছেলে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। পড়াও শেষ করেন। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে নিজের জন্য নিজের গোষ্ঠীর জন্য যখন কিছু করার কথা, তা না করে তিনি পাহাড়ে গড়ে তুললেন এক সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ। পাহাড় বা সমতল সব মানুষের কাছেই এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি ভয়ের-আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স¤প্রতি থানচি ও রুমায় দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় অভিযান চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে কুকি-চিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে ব্যাংক লুটে কুকি-চিন জড়িত এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। তবে থানচি থানায় গোলাগুলির ঘটনায় কুকি-চিন জড়িত কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় বিজিবি।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালের দিকে বম স¤প্রদায়ের ৪০ সদস্যকে মিয়ানমারের কোচিন রাজ্যে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান নাথান। তারা ফেরত আসার পরপরই নাথান গোপন তৎপরতা শুরু করেন। তিনি ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মনোনয়নপত্র বৈধ হয়নি। নাথানের আর নির্বাচনও করা হয়নি। ২০২২ সালের দিকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে একটি আলাদা রাজ্য গঠনের ঘোষণা দেন তিনি। এরপর কেএনএফের কর্মকান্ডের নানা ছবিও পোস্ট করতে থাকেন। বম স¤প্রদায়ের বেশির ভাগই খুব দরিদ্র। এই জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবাই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। নাথান বমের বেড়ে ওঠাও এমন একটি দরিদ্র পরিবারে। তারা পাঁচ ভাই, এক বোন। নাথান সবচেয়ে ছোট। নাথান বম ছাত্রজীবনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন। জেএসএসের এই ছাত্র সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও ছিলেন। তার স্ত্রী লেলসমকিন বম চাকরিজীবী ও দুটি সন্তান আছে। স্ত্রী বান্দরবানের রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে কর্মরত। তবে নাথানের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে- এমন আলোচনা এলাকায় রয়েছে। বান্দরবানে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষে নাথান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। সেখান থেকে স্নাতক করেন। যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেছেন বলেও নিজে দাবি করতেন। স্থানীয়রা মনে করেন এনজিও গড়ে তোলার সময় নাথান কিছু টাকা পেয়েছিল। যদিও তার উৎস সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না। সে সময় থেকে নাথান বম এলাকার মানুষকে বিশেষ করে যুবকদের একত্রিত করা শুরু করেন। প্রথম দিকে এলাকার মানুষ এটাতে খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু একপর্যায়ে তারাও কিছুটা সন্দেহ করতে শুরু করেন। কেউ কেউ নাথানকে সতর্কও করেন। অনেকেরই ধারণা এই এনজিওর আড়ালে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করতেন নাথান। বাংলাদেশে কাজ করে এমন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদন করেন নাথান। কিন্তু সেটি পাননি তিনি। এরপর নিজ এলাকায় রিসোর্টও করেন। কিন্তু সেখানেও সফল হতে পারেননি। ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একটি এনজিও গড়ে তোলেন। কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে সেই এনজিও দাঁড় করাতে না পারার পর নাথান কীভাবে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুললেন সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। নাথানের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা নিয়ে তাই এলাকায় আছে নানা আলোচনা। তবে নিশ্চিত করে কেউ কিছুই বলতে পারেন না। স্থানীয় ও তার স্বজনরা শুধু এটুকুই বলতে পারেন ২০১৮ সাল থেকে নাথান বমের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ তারা দেখতে পান।
এমপিও হতে চেয়েছিলেন নাথান : ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। যদিও সেটি বাতিল হয়ে যায়। তবে ওই বছর নাথান ও আরও কয়েকজন যুবক পার্শ্ববর্তী মিয়ানমানের চিন রাজ্যে গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে এবং এরপর সে প্রায়ই ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায়। ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের দিকে নাথান স্থানীয় একজনকে নিজের এনজিওর অফিসে তুলে মারধর করেন। আহত অবস্থায় তাকে ফেলে দেওয়া হয়। এর পরপরই নাথান এলাকা ত্যাগ করেন। স্থানীয় ও নাথানের স্বজনদের ধারণা মিজোরাম ও চিনের কোনো গোষ্ঠী এবং দেশের ভিতরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী চাকমাদের ওপর বিদ্বেষ আছে এমন কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি নাথানকে সহযোগিতা করেছে।