বাংলাদেশঃ আত্মঘাতী ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় !!!

0
10

রতন তালুকদারঃ একাত্তরের মুজিব নগর থেকে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর একসূত্রে গাঁথা। ৫ই আগষ্ট ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ী মানুষগুলি কয়েক ঘণ্টায় বাংলাদেশের মানচিত্রের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধূলায় লুণ্ঠিত করে বিজয়ে মেতে উঠে। যেমনটি হয়েছিল ৭৫-এর ১৫ই আগষ্টে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। সেবার বঙ্গবন্ধুর কথিত সৈনিকরা গা ঢাকা দিয়েছিলো কেউ কাঁদেনি, কেউ রাস্তায় নামেনি। এবারও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শোচনীয় ও লজ্জাজনক পলায়নে কথিত শেখ হাসিনার সৈনিকরা “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” ফর্মুলায় তাদের নেত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এদিক ওদিক পালায়, আত্মগোপনে যায় এবং সঙ্গে নিয়ে যায় ১৫ বছরের সঞ্চিত চুরির সম্পদ!

এদিকে বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অপরাধে নেমে আসে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর এক অবর্ণনীয় দুঃখ বেদনা ও আতঙ্ক। ওরা যেন নিজ দেশে পরবাসী ও ভিন্ন গ্রহের মানুষ!

ভারতের উত্তর প্রদেশে একজন বুলডোজার বাবা আছেন। তিনি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথ। বাংলাদেশের বুলডোজার বাবা সমন্বয়কারী ছাত্ররা, পেছনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মদদ। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন না থাকলে ৩২ নম্বর অভিযান সফল হতো ? দেশটি কি মগের মুল্লুক !

সামনে ওরা হয়ত গোপালগঞ্জে টুঙ্গীপাড়ার কবর থেকে বঙ্গবন্ধুর হাড্ডি-গুড্ডি তুলে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মতো বঙ্গোপসাগরে সলিল সমাধি করবে। আরও অনেক কিছু দেখবে বাংলাদেশ! মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বপ্নভঙ্গ সবে শুরু। শেখ হাসিনার দম্ভ, আত্ম-অহংকার, গণতন্ত্র হত্যা, ভোট ডাকাতির নির্বাচন, খুন, গুম এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের সীমাহীন চুরির বাণিজ্য যে কত ভয়াবহ ও নির্মম ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের আগুন তাই প্রমাণ করে।

বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ও আদিবাসীরা চিরদিনই শান্তিপ্রিয়, দেশপ্রেমিক ও সোজা সরল প্রকৃতির। বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দ্বারা দেশে কোন অরাজকতা, দেশদ্রোহিতা, অন্যায়, অবিচার সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বা আইন নিজ হাতে তোলে নেয়ার কোন রেকর্ড নেই গত ৫৪ বছরে।

শান্তিপ্রিয় এই নিরীহ মানুষগুলির ওপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কতিপয় এবং খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র বারবার আঘাত এনেছে। ৭২ থেকে শুরু, চলমান ২০২৫ পর্যন্ত। লক্ষণ দেখে বোঝা যায় এই নিগ্রহ অত্যাচার বৈষম্য চলতেই থাকবে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় প্রথম দূর্গাপুজায় মূর্তি ভাঙ্গা হয় সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। সম্প্রদায়িকতার মর্মান্তিক রেলগাড়ি কখনো লাইনচ্যুত হয়নি। রামু থেকে নাসির নগর, যশোরের অভয় নগর থেকে রংপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামের লোগান থেকে চট্টগ্রামের বাঁশখালি পযর্ন্ত সাম্প্রদায়িকতার কলেবর প্রশস্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা হিন্দুদের রক্ষক হিসেবে ভারতের কাছে দেবী ছিলেন। ভারত ভেতরের খবর নেয়নি, তারা বাংলাদেশের সাথে ব্যবসায় মত্ত ছিলো।

শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাসের বলি হয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়। জানমালের নিরাপত্তার অভাব, উপাসনালয়ে ভাংচুর, হিন্দু মেয়েদের উপর লোলুপ দৃষ্টি ও ধর্ষণ, জোর করে ধর্মান্তরিত করার প্রবণতা, পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী শূন্য করার নীরব প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছে।

শেখ হাসিনার সোনার ছেলে ছাত্রলীগ দিনে-দুপুরে পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তথাকথিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সুনামগঞ্জের ঝুমন দাস, রংপুরে টিটু, বরিশালের সুমন ও কুমিল্লার নারায়ণ সহ শত শত হিন্দু যুবককে ধর্ম অবমাননার নামে জেলে দেয়া হয়েছে। হিন্দু শিক্ষকের গলায় জুতার মালা দিয়ে গলাধাক্কার ঘটনাগুলি এখনো সংখ্যালঘুদের আতঙ্কিত করে।

৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনার লজ্জাজনক পলায়নের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নেমে আসে অমাবস্যার কালো রাত্রি। কারও অজানা নয় যে সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে তাদের চিরচেনা মানুষগুলিও অচেনা হয়ে আঘাত এনেছে। ওদের কেটেছে বিনিদ্র রজনী। তথাকথিত সংঙ্কার আর বৈষম্যহীন বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়ে উঠে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের করুণার পাত্র। কি বিচিত্র এই মুল্লুক, আমরা কোন গ্রহে বসবাস করছি?

ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। পৃথিবীর প্রায় দেড়শো দেশে ইসকন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেবা দিচ্ছে। অনেক মুসলিম দেশেও ইসকন বহাল তবিয়তে আছে এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও। মামুলি অভিযোগ এনে বাংলাদেশে ইসকন নেতা শ্রী চিন্ময় প্রভুকে জেলহাজতে রাখা হল জাতীয় পতাকার অবমাননা ও দেশদ্রোহিতার কাল্পনিক অভিযোগে, পক্ষান্তরে জাতীয় পতাকাকে জায়নামাজ বানিয়ে এর উপর দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলে অবমাননা হয় না?

বাংলাদেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলির গুতা-গুতিতে শিলপাটার ঘর্ষণে যেমন মরিচের জান বিপন্ন তেমনি মুসলিম সম্প্রদায়ের ইসলাম রক্ষার সংগ্রামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আত্মমর্যাদা, সহাবস্থান ও নিরাপদে বসবাস হুমকির মুখে।

এসব নাটক, গল্প উপন্যাস আর কত? দয়া করে হিন্দুদের বাঁচান। ওরা মানুষ, বাংলাদেশের ভূমিপুত্র। একাত্তরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভূমিকা ছিল গগন ছুঁই ছুঁই দেশপ্রেম।

শেখ হাসিনার অপরাধে তাকে এনে শাস্তি দিন। পারলে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন। বাংলাদেশের পতাকা, সঙ্গীত সংবিধান সব বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করে ওপারের পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা চান, তাতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের কিছুই আসে যায় না। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা শুধু নিরাপদ থাকতে চায়, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে চায়, তারা চায় ঘরে ষোড়শী মেয়েটি যেন নিরাপদ থাকে।

বাংলাদেশের প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল ও সরকারের তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বয়ানে সংখ্যালঘুরা আর ভরসা রাখতে পারছে না। ক্রমাগত হিন্দু বিদ্বেষ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবনে, মননে ও চেতনায় ভয় ও দুঃস্বপ্নের হাতছানি দেখছে! মনের ভেতর রেখাপাত করছে একাত্তরের পাকহানাদার বাহিনীর নির্মমতা ও হত্যাযজ্ঞ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবনের বাঁকে বাঁকে তারা ধৈর্য্যর অগ্নি পরীক্ষা দিচ্ছে। তবু পরাজিত সৈনিকের মতো ওরা আর ভারতে যাবে না, দেশের মাটির ঘ্রাণ নিয়েই ওরা আজন্ম, আমৃত্যু এদেশেই শিকড় ধরে বেঁচে থাকবে।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভাঙ্গার ব্যাথা বুকে চেপেই বলবো, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি “কে” ভেঙ্গেছিল? দিল্লির চার দেয়ালের ভেতর হতাশায় ভুগতে ভুগতে শেখ হাসিনা ভেবে দেখুন। একমাঘে শীত যায় না, উপর দিকে থুথু দিলে নিজের মুখেই এসে পড়ে।

আজ যাঁরা ধানমন্ডির বাংলাদেশের ঠিকানা ৩২ নম্বর ভেঙ্গে উল্লাস করছে, খিলখিল করে হাসছে তারা একদিন ইতিহাসের মীর জাফর আলী খাঁন হবে।

তারপরও শেখ মুজিব একাত্তরের সূর্য, দেশের স্থপতি।

পাদটীকাঃ ৩২ নম্বর ভাঙ্গার পর নিউইয়র্কে কতিপয় সুশীল সমাজ ও চেতনাধারী হিজড়া প্রতিবাদ করেছে। এদের বেদনা ৩২ নম্বর নয়। বাংলা একাডেমী, একুশ বা স্বাধীনতা পুরস্কার না পাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ !!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here