দুই তলা বাস। খোলা ছাদ। বাসের ইস্পাতের গায়ে বড় করে লেখা ‘চ্যাম্পিয়ন’। খোলা ছাদে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি হাতে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। মাঝে-মধ্যেই এ ট্রফি হাতবদল হচ্ছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের উদ্দেশে ট্রফি উঁচিয়ে ধরছেন বীরের বেশে নিজের দেশে ফেরা সাবিনা খাতুনরা। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাফুফের দিকে যেতে যেতে পথের দুই ধারে এভাবেই অভিনন্দিত হয়েছেন নারী ফুটবলাররা। অভিনন্দনের জবাবও দিয়েছেন তারা কাক্সিক্ষত ট্রফি দেখিয়ে। অনুচ্চারে নারী ফুটবলাররা যেন বলছিলেন- দেখো, এটা তোমাদেরই জন্য নিয়ে এসেছি। গতকাল সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়তেই বিমানবন্দরে সংবাদকর্মীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। ভিআইপি গেটের পাশে চলে আসে নারী ফুটবলারদের বহনকারী বাস। এরপর থেকেই অপেক্ষা। আড়াইটায় চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা ঢাকায় পা রাখেন। বিমানবন্দরেই তাদের ফুল দিয়ে বরণ করেন বাফুফের সহসভাপতি ফাহাদ করিম। তার সঙ্গে ছিলেন বাফুফের আরও অনেকে। ফুলেল শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় সিক্ত হন সাবিনা, তহুরা, মনিকা, শামসুন্নাহার, আফিদা, ঋতুপর্ণারা। বিমানবন্দরেই সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
অনেক বছর ফুটবল হেঁটেছে অন্ধকার পথে। সেই পথে ফুটবলারদের খুঁজে পাওয়া ছিল বেশ মুশকিল। একসময় মুন্না-কায়সার-সাব্বিরদের দাপটে আড়ালে পড়ে যেত অন্য সব। তাদের দ্যুতিতে জ্বলমল করত দেশের ফুটবল। এরপর শুরু অন্ধকার যুগ। গত এক দশক ধরে সেই অন্ধকার থেকে ফুটবলকে আলোর পথে নিয়ে আসতে বড় ভূমিকা রেখেছেন নারী ফুটবলাররা। বয়সভিত্তিক দলগুলো একে একে নানা ট্রফি নিয়ে আসে। ফুটবলাররা ধীরে ধীরে বড় হয়েছেন, ট্রফির সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে আরও বড় টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ। বয়সভিত্তিক দলগুলোর খেলোয়াড়রা সিনিয়র দলে যোগ হতেই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বড় শক্তি হয়ে ওঠেন তারা। ২০২২ সালে ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত দেশবাসীকে উপহার দেন সাবিনা খাতুনরা। ভারত, পাকিস্তান আর নেপালের মতো শক্তিগুলোকে হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন তারা। চকচকে ট্রফি নিয়ে দেশে ফেরেন। দুই বছর আগে সাবিনারা দেশে ফিরলে রাস্তার দুই ধারে উপচে পড়ে মানুষ। চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের দেখতে ভিড় জমায় তারা। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় রাজধানী ঢাকা। বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে যেতে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। কয়েকজন ফুটবলার উৎসব করতে করতে কিছুটা অসুস্থও হয়ে পড়েন। গতকাল আরও একটা ইতিহাস গড়া দল এলো বাংলাদেশে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার সেরা এক দল সাবিনারা। বাংলাদেশের ছেলেরা যা পারেননি কখনো, তাই করে দেখাল মেয়েদের দল। তবে এবার ২০২২ সালের মতো অতটা আগ্রহ দেখা গেল না। বিমানবন্দরের সামনে প্রধান সড়কে কয়েক শ ফুটবলপ্রেমী এসেছিলেন। তারা লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে অভিবাদন জানান নারী ফুটবলারদের। এরপর যানজট এড়াতে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বাফুফে ভবনের দিকে এগিয়ে যায় চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের বহনকারী বাস।
বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে নারী ফুটবল দলের কোচ পিটার বাটলার বলেন, ‘এই শিরোপা বাংলাদেশের মানুষেরই। শিরোপা জেতাটা বড় কথা নয়, যে ধরনের ফুটবল মেয়েরা খেলেছে, সেটাই আনন্দের জায়গা।’ অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের কণ্ঠে শোনা গেল ভবিষ্যতে আরও সাফল্য আনার দৃঢ়তা। তিনি বলেন, ‘আমরা এই শিরোপা জিততে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। আমরা দেশের মানুষের কাছে দোয়া চাই। যাতে এমন সাফল্য আরও উপহার দিতে পারি।’ বাংলাদেশের মেয়েরা একের পর এক সাফল্য বয়ে আনুক। কেটে যাক ফুটবলের সব অন্ধকার। সাফজয়ী নারী ফুটবলারদের জন্য ১ কোটি টাকার বোনাস ঘোষণা করেছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। বিসিবি দিচ্ছে ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা সংবর্ধনা পাবে কাল।