ঢাকা : অতিকুল্লাহ খাঁনের বাসা নগরীর নন্দনকাননে। সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছে জিন্মি থাকা ২৩ নাবিকের একজন তিনি। প্রধান কর্মকর্তার পদে থাকা আতিক এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠেছেন মাস চারেক আগে। এর মধ্যেই জলদস্যুদের কবলে পড়েছে তাদের জাহাজ। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে আতিকুল্লাহ খাঁনের পরিবারে ততই গাড় হচ্ছে যেন বিষাদের ছায়া। তাঁর ষাটোর্ধ মা শাহনূর আক্তার ছেলের জন্য কিনেছেন ঈদের পায়জামা ও পাঞ্জাবি। কিন্তু ঈদের আগে আর ফিরছে না ছেলে। তাই শাহনূর আক্তারের চোখ করছে ছলছল।
চোখ মুছতে মুছতে শাহনূর আক্তার বলেন, ‘আশা ছিল, ছেলে আসবে ঈদের আগেই। জাহাজের মালিকপক্ষ সেই আশ্বাসই দিয়েছিলেন শুরুতে। কিন্তু এখন বলছে ঈদের পরে আসবে। ছেলে আসার দিনই হবে আমাদের ঈদ। ঈদের শাড়িও পড়বো সেদিন।’
আতিকুল্লাহর বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায়। সপরিবারে বসবাস করেন নগরীর নন্দনকাননের রথেরপুকুর পাড় এলাকায়। সেখানেই কথা হয় তার পরিবারের সঙ্গে। কথার ফাঁকে ফাঁকে সদস্যদের কান্না ঠুকরে বের হয়। ছবি হাতে বাবাকে খুঁজে ফিরছে আতিকের ছোট ছোট তিন মেয়ে। বাবাকে নিয়ে তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে বুক ভেঙে যায় দাদির। আতিকুল্লাহর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। ভেঙে পড়েছেন তিনি। আত্মীয়স্বজন সান্ত¡না দিলেও অশ্রুবাণ থামছে না মা ও স্ত্রীর।
আতিকুল্লাহর বাবা বেঁচে নেই। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। মা, ভাই, স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে শহরের নন্দনকানন এলাকায় থাকেন তিনি। ছোট ভাইয়ের পড়ালেখা শেষ হয়নি। তিন মেয়ের মধ্যে বড় ইয়াশা ফাতিমা পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। মেজো মেয়ে উমাইজা মাহাবিন প্রথম শ্রেণিতে। আর ছোট মেয়ে খাদিজা মাহাবিনের বয়স মাত্র দুই বছর।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খানের সঙ্গে আরও ২২ নাবিক জিম্মি। গত ১২ মার্চ তাদের ভারত মহাসাগর থেকে জিম্মি করে সোমালিয়ার সশস্ত্র জলদস্যুরা।
প্রহর গুনছেন জান্নাতুল
এমভি আবদুল্লাহর চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ ও নাবিক নুরউদ্দিনের পরিবারে ঈদ কাটবে অশ্রুসজল। তানভীরের মা জোছনা বেগম বলেন, ‘সবাই ছেলের অপেক্ষায় আছি। ঈদের আগেই ফিরবে- শুরুতে জাহাজের মালিকপক্ষ আশ্বাস দিলেও, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। দস্যুর ডেরায় ছেলেকে রেখে ঈদ করব কীভাবে?’
অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নাবিক নুরউদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। স্বামীর সন্ধানে কবির গ্রæপের কার্যালয়ে ঘুরেছেন কর্ণফুলীর লিচুতলার বাড়িতে আড়াই বছরের সন্তান রেখে। জান্নাতুল বলেন, জিম্মি করার পরপরই এক অডিও বার্তায় নুরউদ্দিন বলেছিল- ‘ফাইনাল কথা, এখানে টাকা না দিলে একজন একজন করে মেরে ফেলবে বলছে।’ মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভয় রয়েই গেছে। চিন্তায় ঘুম আসে না। ছোট্ট সন্তান বাবা ছাড়া ঈদ করবে, ভাবতেই বুকে কেঁপে ওঠে।
বুকের ধন জিম্মি রেখে কি করে হয় ঈদ
খুলনা ব্যুরোপ্রধান মামুন রেজা জানিয়েছেন, এমভি আবদুল্লাহর দ্বিতীয় প্রকৌশলী খুলনার তৌফিকুল ইসলামের পরিবারে নেই আনন্দ। নগরীর সোনাডাঙ্গার করিমনগর এলাকার বাড়িটি এখন নিষ্প্রাণ। কারও জন্য কেনা হয়নি পোশাক। তৌফিকের মা দিল আফরোজা বলেন, ‘ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা তো আছেই। না পারছি কাছে যেতে; না পারছি দেখতে। বুকের ধন জিম্মি রেখে ঈদ আনন্দ কি থাকে? কারও জন্য কেনাকাটা করা হয়নি। ওর মেয়ে তাসফিয়া নামাজ পড়ে দোয়া করে। ছোট ছেলে মুসাফি বলে, আমি গিয়ে যুদ্ধ করে বাবাকে ছাড়িয়ে আনব।’
গত রোববার তিনি বলেন, ‘ছেলে বলেছে, তারা ভালো আছে। জামাতে তারাবি নামাজ ও রোজা রাখতে পারছে। দুর্ব্যবহার না করলেও বেশিক্ষণ ফোনে কথা বলতে দেয় না। পাশে জলদস্যুরা দাঁড়িয়ে থাকে। আগে সবাইকে এক কক্ষে রাখলেও এখন কেবিনে থাকতে পারছে।’ তৌফিকের স্ত্রী জোবাইদা নোমান বলেন, ‘আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খুব কষ্টে আছে। বাবার জন্য তারা অস্থির হয়ে উঠেছে।’
সাইদুজ্জামানের পরিবারে চলছে নীরব কান্না
নওগাঁ প্রতিনিধি কাজী কামাল হোসেন জানিয়েছেন, শহরের পলিটেকনিক অ্যাভিনিউর দুবলহাটি রোডে এমভি আবদুল্লাহর প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম সাইদুজ্জামানের পরিবারে চলছে নীরব কান্না। ঈদের দিন ঘনিয়ে এলেও করেনি কোনো কেনাকাটা, নেই রান্নাবান্নার প্রস্তুতি।
সাইদুজ্জামানের বাবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও নওগাঁ জেলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, সুস্থভাবে ছেলের ফেরার অপেক্ষায় আছি। একটা সময় খুব ভয় পেয়েছিলাম। এখন সান্ত¡না পাই, মাঝে মধ্যে কথা বলতে পারছি। জলদস্যুরা যোগাযোগে কোনো বাধা দিচ্ছে না। মা কোহিনূর বেগম বলেন, আমাদের কারও মাঝে ঈদের আনন্দ নেই। ছেলেকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না। কবে ফিরবে আমার বুকের ধন? সরকার যেন দ্রæত উদ্যোগ নেয়।
সাইদুজ্জামানের স্ত্রী মান্না তাহরিন শতধা বলেন, স্বামী ফিরে এলে এবার ঈদ হতো সবচেয়ে আনন্দের। এখন নিজেরা নিজেদের সান্ত¡না দিচ্ছি- বেঁচে আছে, এক দিন আল্লাহ আমাদের কাছে তাকে ফেরত দেবে।
ছেলে নাই, টাকা পাঠানোরও কেউ নাই
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম খান রানা জানিয়েছেন, এমভি আবদুল্লাহর নাবিক নাজমুল হকের সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের চর-নুরনগর গ্রামের বাড়িতে নেই প্রাণচাঞ্চল্য। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে বাবা আবু সামা ও মা নার্গিস খাতুনের।
গত শনিবার বাড়িতে বসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নার্গিস বলেন, ‘ছেলে যেখানেই থাকুক, ঈদ এলে টাকা পাঠাত। সময় পেলে নিজে কিনে দিত। এবার আমার ছেলেও নাই, টাকা পাঠানোর কেউ নাই। সারাক্ষণ মনে হয়, নাজমুল এসে মা মা বলে ডাকছে। ওদের সবাই ঈদের আগে মুক্তি পেলে সবচেয়ে খুশি হতাম। নাজমুলের বাবা আগেই অসুস্থ। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে আরও অসুস্থ হয়ে গেছে। তাকে নিয়েও চিন্তা হচ্ছে।’
সাব্বির কল করবে, ফোন হাতে অপেক্ষায় বাবা
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি আবদুর রহিম জানিয়েছেন, এমভি আবদুল্লাহর মার্চেন্ট কর্মকর্তা সাব্বির হোসেনের পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। একমাত্র ছেলের জন্য কেঁদে কেঁদে ফিরছেন মা সালেহা বেগম। প্যারালাইসড বাবা হারুন-অর রশিদ সারাদিন মোবাইল ফোন হাতে বসে থাকেন, ছেলের ফোন পাওয়ার আশায়।
সরেজমিন টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সহবতপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গা ধলাপাড়া গ্রামে গিয়ে সাব্বিরের বাড়িতে সুনসান নীরবতা পাওয়া যায়। ডাকাডাকির এক পর্যায়ে আসেন একমাত্র বোন মিতু আক্তার। তিনি জানান, ভাই জিম্মি হওয়ার পর থেকে সবাই উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। মা-বাবা কেঁদেই চলেছেন। ভাইয়ের কিছু হলে তাদের বাঁচানো যাবে না। ঈদের আনন্দ আমাদের কাছে বিষাদে পরিণত হয়েছে।
হারুন-অর রশিদ বলেন, জিম্মি হওয়ার পর এক দিন সাব্বিরের সঙ্গে কথা বলেছি। তার পর আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমি ও আমার স্ত্রী ফোন হাতে বসে থাকি, কখন সাব্বির কল দিয়ে বলবে- বাবা, ভালো আছি, তোমরা চিন্তা করো না। গত বছর একসঙ্গে ঈদ করেছি। এবার পারব না, ভাবতে পাজর ভেঙে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষের প্রতিনিধি কেএসআরএমের গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘ঈদের আগে নাবিকদের মুক্ত করতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। আমাদের আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে। ঈদের পরে তারা মুক্ত হবেন।’