বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি

0
345

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া অনিবার্য হয়ে ওঠেন আশির দশকের শুরুতে। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বিএনপিতে বিভক্তি দেখা দেয়। দ্বিধা-বিভক্তির কুশীলবদের নাম-ধাম না বলে এভাবে বলতে পারি, সুবিধাবাদী গ্রুপ এবং আদর্শবাদী গ্রুপ। সুবিধাবাদী গ্রুপ এরশাদ সরকারে যোগদান করার জন্য বিএনপিকে বিভক্ত করার উদ্যোগ নেয়। অপর দিকে আদর্শবাদী গ্রুপ জিয়াউর রহমানের আদর্শকে আঁকড়ে থাকার উদ্যোগ নেয়। বিভক্তি এড়ানোর জন্য ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়াকে দলের নির্বাহী চেয়ারম্যান করা হয়। খালেদা জিয়া কোনো মতেই রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক অনুরোধ উপরোধ করে তাকে রাজি করানো হয়। এভাবে বিচারপতি সাত্তারের পদত্যাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত (২০২৩) কার্যত তিনিই দলটির কর্ণধার। যিনি ছিলেন নিরেট গৃহবধূ, তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেন।

সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দলের প্রধান হিসেবে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে তিনি তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকিত করেন। বিএনপি সম্পর্কে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং বিরোধীদের মন্তব্য ছিল, এটি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সেনা ছাউনি’ থেকে সৃষ্ট সরকারি দল। তিনি সে বদনাম ঘুচিয়ে আপসহীন সংগ্রামের মাধ্যমে বিএনপিকে জনগণের দলে পরিণত করেন। এটি কোনো ভক্তের অতিশয় উক্তি নয়।

দেশের শীর্ষ স্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর রওনক জাহান মন্তব্য করেন, ÔShe (Khaleda Zia) succeeded in transforming the BNP from a state sponsored party to an opposition party, (Rounaq Jahan, Political Parties in Bangladesh, 2015, P-31) এভাবে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিত্ব, দূরদৃষ্টি ও কৌশল বিএনপিকে বারবার ভাঙন থেকে রক্ষা করে। যারা জিয়ার আদর্শকে পরিত্যাগ করে হিরো হতে চেয়েছেন অবশেষে তারাই জিরো হয়েছেন।

এটি একটি সাধারণ সত্য যে, বাংলাদেশে উত্তরাধিকারের রাজনীতি একটি অনিবার্য বিষয়। এই উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে নেতৃত্ব যদি হয় সুশাসনের ধারক, কল্যাণকামী ও জনগণের জীবনবোধের প্রতিভূ তাহলে জনগণ সতত আনুগত্য প্রকাশ করে। আর যদি তা হয় কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী তাহলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে যখন সবাই একটি পরিত্যক্ত দলের পুনরুত্থান আশঙ্কা করেছিল তখন জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জনগণের সম্মতিতে আবারও প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রমাণিত হয়, ‘বাংলাদেশ জাগ্রত জনতার’। কিন্তু যারা জনগণের ভোটে কখনো নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে না তারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ খোঁজে। এভাবেই ঘটে ১/১১’র অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলি। ‘ব্যতিক্রমী নির্বাচনের মাধ্যমে যে অভিনব সরকার’ (ইয়াহিয়া আখতার : ২০০৯) প্রতিষ্ঠিত হয়, ২০২৩ সালের এই প্রান্তে এসেও তাদেরকেই বাধ্যতামূলকভাবে ধারণ করতে হয়। উত্তরাধিকারের রাজনীতির বিপরীত ধারকরা নিশ্চিত করেই জানে যে, জনসমাদৃত প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপিত হলে তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। তাই ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন ও ২০১৮ সালের নিশীথ রাতের নির্বাচন। ২০২৪ এর জন্য অনুরূপ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হবে- এটা নাবালকও বোঝে। আর জিয়া পরিবার যে তাদের সামনে একমাত্র চ্যালেঞ্জ, তাও তারা বোঝে। সে কারণেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা, অন্যায় কারাবাস ও দুরভিসন্ধির রাজনীতি। ক্ষমতাসীন দলের সর্বশেষ নাটক আবারও খালেদা জিয়াকে নিয়ে।

বিষয়টি সম্পর্কে বিবিসির ভাষ্যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় : খালেদা জিয়া বিতর্ক : আন্তর্জাতিক চাপ নাকি বিএনপির জন্য ‘ট্র্যাপ’? বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করা নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা সরকার সচেতনভাবেই করছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক মহল। তারা বলছেন, এর পেছনে আন্তর্জাতিক চাপসহ নানা কারণ থাকতে পারে। অবশ্য সরকার বলছে যে, খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে যে বিতর্ক তার পেছনে সরকারের কোনো দুরভিসন্ধি নেই। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি রয়েছে তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতেই এমন বিতর্ক শুরু করতে পারে আওয়ামী ল্লীগ। সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করা নিয়ে সরকারের অন্তত চারজন মন্ত্রী নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন যা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আইনমন্ত্রী ছাড়াও আওয়ামী ল্লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। একই মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদও। তবে কিছুটা ভিন্ন মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই মিসেস জিয়ার। আর আইনমন্ত্রী বলেছেন, রাজনীতি করতে কোনো বাধা না থাকলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বিএনপির সভানেত্রী।

সরকারের একাধিক মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, বিএনপি প্রধানের ব্যাপারে এই সময়ে এসে কেন মন্ত্রীরা এ ধরনের মন্তব্য করছেন? এটা কি বিএনপির জন্য ‘ট্র্যাপ’? এই প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানা বলছেন, সরকারের ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, যার কারণে আওয়ামী ল্লীগ খালেদা জিয়াকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করছে। তার মতে, প্রথমত আন্তর্জাতিক মহল বারবারই বিএনপিকে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার জন্য সরকারকে বলছে। একই সাথে, প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে এভাবে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে একটার পর একটা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দেখানোটাও সরকারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করছে।

ফারহানা মনে করেন, দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের যে দু’রকমের বক্তব্য সেটা আসলে বিএনপির জন্য একটা ‘ট্র্যাপ’ বা ফাঁদ। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এখন রাজনীতিতে সক্রিয় হলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে যে, তিনি সুস্থ আছেন। তাই তার আসলে বাসায় থাকার দরকার নেই। তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হোক।

রুমিন ফারহানা আরও মন্তব্য করেন, ‘এই সরকার অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ, ধূর্ত ও মিথ্যাবাদী। তাই এই সরকার কী উদ্দেশ্যে কী করে সেটা বলা মুশকিল।’ এই বিতর্কের সূচনা করেন আওয়ামী ল্লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। গত ২৬ জানুয়ারি সংসদে তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন যে, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন মুচলেকা দেয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতে তাকে বাসায় নেয়া হয়েছে। সংসদে মি. সেলিমের এমন বক্তব্যের পরই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।

উল্লেখ্য, দুর্নীতির দু’টি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি দেয়া হয়। এরপর থেকে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। অসুস্থ থাকার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়েছে তাকে। শেখ সেলিমের উত্থাপিত শর্ত সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেছেন, এমন কোনো শর্ত ছিল না। মুক্তি দেয়ার সময় সম্ভবত দুটো অলিখিত শর্ত ছিল। সেগুলো হচ্ছে, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নিবেন এবং তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, ‘খালেদা জিয়া যদি অসুস্থ থাকেন তাহলে তিনি রাজনীতি করবেন কিভাবে?’ আর যদি সুস্থ থাকেন তাহলে তার স্থগিত দণ্ডাদেশ আবার চালু করা হবে এবং তাকে কারাগারে গিয়ে তার মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে। সে কারণেই বলা হচ্ছে যে, তার রাজনীতি করার সুযোগ নেই।

এখন কেন বিতর্ক? স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাসায় থাকার মেয়াদ প্রায় তিন বছর হতে চলল। এতদিন কোনো মন্তব্য না আসলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসার কারণে এখন তার রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য আসছে বলে মনে করছে বিএনপি। সামনে নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে তৎপরতা রয়েছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। বিএনপির প্রধান দাবি হচ্ছে, খালেদা জিয়াকে কারান্তরীণ রেখে এবং দল্লীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহল একটা চাপ তৈরি করেছেন যাতে সামনে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে হয়। এটি একটি কারণ হতে পারে এই সময়ে এমন বিতর্কের জন্য। খালেদা জিয়ার দৃশ্যত মুক্তি এবং অদৃশ্য আইনি কারসাজির মাধ্যমে তাঁকে অকার্যকর করার কূটবুদ্ধি থেকে বিতর্কটি উত্থাপিত হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এ ধরনের রাজনৈতিক ছাড় দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশলও হতে পারে এই বিতর্কের উৎস। একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বলা হয়, বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিসহ নানা নাগরিক ভোগান্তির দিক সামনে এনে একটি আন্দোলন দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। একই সাথে তারা নির্দল্লীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেও অটল রয়েছে। এই অটল মনোভাবকে টলায়মান করার জন্য ক্ষমতাসীনদের ফন্দি ফিকিরের অংশ হিসেবে বিষয়টি উত্থাপিত হয়ে থাকবে।

সবকিছু ছাপিয়ে এটা স্পষ্টতর হচ্ছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবশ্যম্ভাবী ব্যক্তিত্ব, কোটি কোটি মানুষের মহীয়সী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজও রাজনীতির নিয়ামক। তাকে জেলে রেখে কোনো জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আন্তর্জাতিক চাপ তখনই কার্যকর হতে পারে যখন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আন্দোলন প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে। বিগত ১৫ বছরে সেই কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন করতে জাতীয়তাবাদী দল ও ইসলামী শক্তি ব্যর্থ হয়েছে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্মম শক্তি প্রয়োগের রাজনীতির বিপরীতে আন্দোলন কষ্টকর হলেও অসম্ভব ছিল না। রাজনীতি যদি হয় কৌশল ও শিল্পকলার অপরূপ সমন্বয়, তাহলে বিরোধী রাজনীতিকরা সেখানেও ব্যর্থ। এখন সূচিত আন্দোলনকে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। এ ধরনের আন্দোলন এবং শুধুমাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রত্যাশিত। আর তাই যদি হয় গণতন্ত্রকামী সব শক্তিকে সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় বল্লীয়ান হতে হবে। প্রতিজ্ঞা হোক, ‘মুক্তি অথবা মৃত্যু’।

লেখক :ড. আবদুল লতিফ মাসুম, অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here