বাজারে অস্বস্তি। সর্বত্র হাহাকার। বাজার করতে গিয়ে মানুষকে চরম হতাশা ও কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। প্রয়োজনীয় চাহিদা তো দূরের কথা মৌলিক চাহিদার অন্যতম প্রধান যে খাদ্য-সেটাই ঠিকমতো জুটছে না দেশের বিপুল মানুষের ভাগ্যে। খাদ্য ঘাটতি পূরণে ঋণ করতে হয় দেশের ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারকে। বছরে গড়ে ৪৯ হাজার টাকা ঋণ করে থাকে এসব পরিবার। আত্মীয়, মহাজন এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় পরিবারগুলো। স¤প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ঋণ করে খাদ্য ঘাটতি মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই চিত্র বলে দেয় দরিদ্রসীমার উপরে থাকা মানুষও খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়েছে দেশের প্রতিটি সেক্টরে।
এবারের রমজানের বাজারে আক্ষরিক অর্থে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়েনি। অনেক কিছুর দাম ঠিক করে দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়ে নাই। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।
এর মধ্যে মানবজমিনের বিস্তারিত সরজমিন প্রতিবেদনে ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান বাজারগুলোর চিত্র ও ঈদের বাজারে জনগণের কেনাকাটার চিত্র উঠে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে কোনো বাজারেই স্বস্তি নাই। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে ঈদ বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। নিউ মার্কেটে আগের চেয়ে বেচাকেনা কম, বসুন্ধরাতে প্রত্যাশিত ভিড় নেই, মৌচাকের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আসল উঠানোই কষ্ট হবে, বঙ্গবাজার ধুঁকছে, গাউছিয়াতে বিক্রি নিয়ে হতাশ ব্যবসায়ীরা, যমুনা ফিউচার পার্কে ক্রেতারা ঘুরছেন, বেনারসি পল্লীতে হতাশা, ক্রেতার অপেক্ষায় ইসলামপুর- এই হলো এক নজরে সরজমিন চিত্র। ঢাকার প্রধান প্রধান বাজারেই যেহেতু এই অবস্থা ফলে সারা দেশের বাজারের চিত্র এরচেয়ে আরও করুণ হবে- এটাই স্বাভাবিক।
এই চিত্রই বলে দেয় দেশের মানুষ ভালো নাই। অর্থনৈতিক ভাবে ভালো না থাকলে তার প্রভাব পড়ে সর্বত্র। এর মধ্যেও কিছু কিছুু মানুষ ঠিকই কেনাকাটা করছেন; এমনকি বিলাসী পণ্যও কিনছেন। ধরে নেয়া যায় অর্থনৈতিক এই মন্দার বাজারে তারা ভালো আছেন। এখন প্রশ্ন হলো তারা কারা? কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তবে যাদের টাকা আছে তারা ঠিকই কেনাকাটা করছেন। তাদের ঈদ মানে বিলাসিতা। তাদের কাছে মূল্যস্ফীতি বলতে কিছু নেই।’
এবং বাস্তবচিত্র হলো বিলাসী পণ্যে বাজারে তাদেরই দেখা যাচ্ছে। সাধারণ পরিবার এমনকি মধ্যবিত্ত ও কিছু ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তদেরও ব্যয় সংকোচন করার জন্য বিভিন্ন হিসাবনিকাশ করতে হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনের বাইরে ব্যয় করার সামর্থ্য যাদের আছে তাদেরও চিন্তা করতে হচ্ছে কীভাবে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে কারা আসলে ভালো থাকেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মত হলো- গণতন্ত্রহীন, ভয়ের সংস্কৃতির উপর ভর করে যে সব দেশ টিকে থাকে সেখানে বেশির ভাগ মানুষের জন্য বাস করা নরকের অভিজ্ঞতা হলেও সেটা কিন্তু সিলেক্টিভ পিপল বা কিছু মানুষের জন্য স্বর্গ। বাংলাদেশও কি এমন সিলেক্টিভ মানুষের স্বর্গে পরিণত হয়েছে? এখনকার বাজারের দিকে তাকালে যাদের সমাগম লক্ষ্য করা যায় তারাই কি সেই স্বর্গের বাসিন্দা। এই বিষয়ে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তৈরি করা হয়েছে এক শক্তিশালী অলিগার্ক (শাসকদের অনুগত বা যাদের নিয়ে শাসক গোষ্ঠী তৈরি) শ্রেণি। এরাই এখানে ভালো আছে। বাংলাদেশে বাজার বা সার্বভৌমত্ব কোনো কিছুতেই তারা খারাপ বোধ করে না। তারা সব কিছুর পরেও ভালো আছে। এবং খুব ভালো যে আছে তা আবার তারা দেখাতেও চেষ্টা করে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, এখানে মেরুদণ্ডহীন, দুর্নীতিপরায়ণ ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী ছাড়া কোনো মানুষ ভালো নাই। ভালো থাকার সুযোগ নাই। শুধু যে অর্থনৈতিক ভাবে বিষয়টা সত্য তা নয়, ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। কথা বলার অধিকার নাই। যার সম্মান নাই; তারা ভালো থাকতে পারে না। সে হয়তো ভালো চাকরি করছে, প্রচুর বাড়ি ভাড়া পাচ্ছে বা ব্যবসায় করে প্রচুর টাকা বানাচ্ছে- কিন্তু ভালো থাকার সুযোগ নাই। আত্মসম্মান যাদের আছে তাদের ভালো থাকা মুশকিল। এমন সার্বিক করাপ্ট একটা রাষ্ট্রে। আর করাপশনে থেকে যারা মনে করছেন ভালো আছেন, অনেক টাকার মধ্যে আছেন- তারা আত্মপ্রতারণার মধ্যে আছেন।
ফলে বাজারে যাদের দেখা যাচ্ছে। বা সরকারদলীয় লোকজন সোশ্যাল মিডিয়াতে বাজারে মানুষ আছে, কেনাবেচা হচ্ছে বলে যে ধরনের কথা বলার চেষ্টা করছেন তা এই সিলেক্টিভ লোকদের দেখেই বলছেন। সব অস্বাভাবিকতাকে স্বাভাবিকতা হিসেবে দেখানোর যে চেষ্টা করছেন তার মূল সত্য হলো- কিছু মানুষ ভালো আছেন। যাদের অঢেল টাকা আছে। আর এটা খুব বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশে সম্ভব ক্ষমতার সঙ্গে থাকলেই। তারাই আসলে ভালো আছেন।