মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্ক কি ভঙ্গুর ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে

0
8

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার দেশ সম্পর্কে একটি রূঢ় পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিলেন। তা হলো- যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হওয়া বিপজ্জনক হতে পারে, কিন্তু তার বন্ধু হওয়া প্রাণঘাতী বিষয়। তার এই পর্যবেক্ষণ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন তার বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তার ভূমিকায় অগ্রসর হচ্ছে, তখন তার জোটগুলো, যা একসময় অটল বলে বিবেচিত হতো, ক্রমশ শর্তসাপেক্ষ বলে প্রকাশ পাচ্ছে। এই ভঙ্গুরতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দুই মিত্র দেশ ইসরাইল ও ইউক্রেনের ক্ষেত্রে।

ইসরাইল গত কয়েক দশক ধরে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে বিশেষ আনুগত্য উপভোগ করে এসেছে, যা একটি শক্তিশালী লবির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হতো। অন্যদিকে, ইউক্রেন সহায়তা নিশ্চিত করতে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের ওপর নির্ভর করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসরাইলের একসময়ের দুর্ভেদ্য অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়ছে। এক নতুন প্রজন্মের মূল্যবোধ, মার্কিন ইহুদিদের মধ্যে নৈতিক হতাশা ও ইউক্রেনের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ‘লেনদেনভিত্তিক পরিত্যাগের’ আশঙ্কা এই ঐতিহাসিক মিত্রতার অবসান ঘটানোর হুমকি দিচ্ছে।

ওয়াশিংটনে ইসরাইলের প্রভাব বহুদিন ধরেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সেখানে ইসরাইলের প্রভাব আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি) ও গভীরভাবে প্রোথিত একটি ইহুদি রাষ্ট্রপন্থী লবির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছিল। এই শক্তি প্রতিবছর ইসরাইলের জন্য বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা ও জাতিসঙ্ঘে কূটনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। সেখানে ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে নৈতিক দায়িত্ব ও কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এই প্রভাব শুধু লবির ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং এটি মার্কিন ইহুদিদের সাথে একটি পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তাদের অনেকেই ইসরাইলকে একটি সাংস্কৃতিক আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখে, যা ইউরোপে ইহুদি গণহত্যার ফলে সৃষ্ট মানসিক আঘাত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্রদের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির অবস্থার মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

এর বিপরীতে, ইউক্রেনের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নেই। ইসরাইলপন্থী লবির তৈরি করা ভিত্তিও এখন ভীষণভাবে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

বিশেষ করে তরুণ প্রগতিশীল মার্কিনীদের মধ্যে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। যেখানে আগের প্রজন্ম ইসরাইলকে গণতান্ত্রিক মিত্র হিসেবে দেখত, সেখানে তরুণরা ক্রমশ এটিকে একটি ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই পরিবর্তনকে তীব্রতর করেছে। অবরুদ্ধ গাজার ধ্বংসস্তূপের ছবি, বিধ্বস্ত হাসপাতাল, শোকার্ত পরিবার ও বাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা শিশুদের নিথর দেহ- এসব তরুণদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

জিউইশ ভয়েস ফর পিস ও ইফনটনাও-এর মতো সংগঠন হাজার হাজার মানুষকে সংঘবদ্ধ করে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে, ইসরাইলি পণ্য বর্জন করতে এবং ইসরাইল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবি জানাতে উদ্বুদ্ধ করছে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৪০ বছরের নিচে ৫২ শতাংশ মার্কিন ইহুদি মনে করেন যে ইসরাইলের সরকার ‘বর্ণবাদী অপরাধে’ দোষী। এটি বরাবরই ইসরাইলকে আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখে আসা সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিশাল পরিবর্তন।

ইসরাইলের নেতৃত্ব যেন এসব বিষয়ে উদাসীন। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অতি-ডানপন্থী জোট, তার বিচার বিভাগীয় সংস্কার যা গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করেছে। এছাড়াও মার্কিন ইহুদিদের সমালোচনাকে তার অবহেলা- ‘তারা আমাদের নিরাপত্তা প্রয়োজনীয়তা বোঝে না’, এসব বিষয় উদারপন্থী মিত্রদের আরো বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। জাতি-রাষ্ট্র আইন ইহুদি আধিপত্যকে সংবিধানে সুরক্ষিত করেছে এবং ক্রমাগত বসতি সম্প্রসারণ শুধু এই ফাটলকে আরো গভীরতর করছে।

মার্কিন ও ইসরাইলি ইহুদিদের মধ্যকার বিভেদ এখন প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে। মার্কিন ইহুদিরা অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল, বহুত্ববাদ ও সমতার পক্ষে। অন্যদিকে, বিশেষ করে নেতানিয়াহুর শাসনকালে, ইসরাইলি ইহুদিরা ক্রমশ জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করছে এবং ফিলিস্তিনিদের বৈধ অধিকারকে ইসরাইলের নিরাপত্তার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করছে। এই সংঘাত ২০২১ সালের গাজা যুদ্ধের সময় তীব্র আকার ধারণ করে। যখন ইসরাইলি মিডিয়া তাদের বোমা হামলাকে আত্মরক্ষা বলে উপস্থাপন করেছিল, তখন মার্কিন ইহুদিরা সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের প্রমাণ দিয়েছিল।

এর প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে। ইসরাইলি কর্মকর্তারা মার্কিন ইহুদিদের ‘অবিশ্বস্ত’ বলে অভিযুক্ত করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন প্রগতিশীল ইহুদিদের ‘ইসরাইলের সবচেয়ে বড় শত্রু’ বলে আখ্যা দেন। ইহুদিবিরোধী ভাবধারায় ভরা এমন ভাষা একটি তিক্ত সত্য প্রকাশ করে- ইসরাইলের সরকারের কাছে দ্বিমত মানেই বিশ্বাসঘাতকতা।

একসময় ‘মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতন্ত্র’ বলে প্রশংসিত ইসরাইলের বিরুদ্ধে এখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও বি’তসেলেমের মতো সংস্থা ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ হওয়ার অভিযোগ তোলে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করছে। এদিকে বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলন বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

মার্কিন ইহুদিদের জন্য এই বিচ্ছিন্নতা বেদনাদায়ক। ইসরাইলকে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে যে মিথ তৈরি করা হয়েছিল, তা এখন চেকপয়েন্ট, বাড়ি ধ্বংস ও পৃথক সড়কের বাস্তবতার সাথে সংঘর্ষে জর্জরিত। তাদের পূর্বপুরুষদের নিপীড়নের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া তরুণ ইহুদিরা ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতির সাথে নিজেদের গণহত্যার বেদনাদায়ক ইতিহাস মিলিয়ে দেখছেন। ২০২২ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৩৫ বছরের নিচে ২৫ শতাংশ মার্কিন ইহুদি ইসরাইলকে একটি বিশেষভাবে ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে সমর্থন করতে রাজি নন, যা একসময় অকল্পনীয় ছিল।

নেতানিয়াহুর অতিরক্ষণশীল দলগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা অরক্ষণশীল ইহুদিদের আরো প্রান্তিক করে তুলেছে। তারা বিয়ে ও ধর্মান্তর সংক্রান্ত আইনে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। গাজায় বন্দীদের মুক্তির আলোচনার চেয়ে সামরিক হামলাকে অগ্রাধিকার দেয়ায় ইসরাইলের মানবিক ভাবমূর্তি আরো কলঙ্কিত হয়েছে।

ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবহেলা একটি ভয়াবহ সতর্কবার্তা বহন করে। শুরুতে মার্কিন অস্ত্র সহায়তায় সমৃদ্ধ হলেও এখন ইউরোপের কাছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছে ইউক্রেন। কারণ রিপাবলিকানদের সমর্থন কমে গেছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একসময় মার্কিন কংগ্রেসে নায়ক ছিলেন। তিনি এখন সেই লেনদেনভিত্তিক মিত্রতার ঝুঁকি তুলে ধরছেন- স্বার্থ পরিবর্তন হলে জোট ভেঙে পড়ে।

ইসরাইলও এর থেকে মুক্ত নয়। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে নেতানিয়াহু জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর ও দখল প্রসারে সহায়তাসহ নানা সুবিধা পেয়েছিলেন। তবে সেই আনুগত্য কেবল কাজে লাগার ওপর নির্ভর করেছিল। দ্বিতীয় দফা ট্রাম্প প্রশাসনে ইসরাইল যদি ’মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ আন্দোলনের অগ্রাধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে, তবে তাকে সহজেই উপেক্ষা করা হতে পারে।

ফলস্বরূপ, এই দখলদার রাষ্ট্র এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। তাদের লবির শক্তি এখনো প্রবল। কিন্তু নৈতিক অবস্থান একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। মার্কিন ইহুদিরা একসময় ইসরাইলের সবচেয়ে দৃঢ় মিত্র ছিল। ক্রমেই তারা জাতিগত সংহতির পরিবর্তে সার্বজনীন ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। দেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের উত্থান এই সম্পর্ককে আরো দুর্বল করে তুলছে। কারণ তরুণ ইহুদিরা বিদেশী সংঘাতের চেয়ে অসমতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ইস্যুগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

ইউক্রেনের পরিস্থিতির সাথে এই সাদৃশ্য স্পষ্ট। যেমন ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সহায়তা স্বার্থ পরিবর্তনের কারণে ম্লান হয়ে গেল, তেমনি ইসরাইলও মার্কিন ইহুদিদের সমর্থন ও শেষ পর্যন্ত মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতা হারালে একই পরিণতির শিকার হতে পারে। বর্তমান ইসরাইলি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে কিসিঞ্জারের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হওয়া অসম্ভব নয়। ইসরাইলও সেই পরিত্যক্ত মিত্রদের তালিকায় যুক্ত হতে পারে, যার করুণ উদাহরণ ইউক্রেনের দুর্ভোগ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here