১৬ মার্চ ২০০৭। ক্যারিবীয় দ্বীপে চলছে বিশ্বকাপ, কুইন্স পার্কে পরের দিন নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ, স্বপ্ন বুনছে ভারত বধের। এমন সময় একটা ফোন কল এলো, আর তাতেই যেন পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল মাশরাফি-সুমনদের। রাসেল, রাজ্জাক চিৎকার করে উঠলেন, মাশরাফি এক দৌড়ে বিছানায়। বাশার শুধু স্ফুটস্বরে বলে উঠলেন, ‘একি করলি রানা?’
মানজারুল ইসলাম রানা, জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার। খুব সম্ভাবনাময় স্পিন অলরাউন্ডার ছিলেন, জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৬টি টেস্ট এবং ২৫টি ওয়ানডে ম্যাচ। ছিলেন মাশরাফি- রাজ্জাক, রফিকদের খুব কাছের বন্ধু। তবে জায়গা হয়নি ২০০৭ বিশ্বকাপের দলে, যা কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনে। বন্ধুরা ক্যারিবীয় দ্বীপে ভারত বধের পরিকল্পনায় ব্যস্ত, তখন রানা সময় কাটাচ্ছিলেন মোটরসাইকেল নিয়ে।
যে মোটরসাইকেল কেড়ে নেয় তার প্রাণ, বাংলাদেশ যেদিন বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবে, তার আগের দিনই পৃথিবীকে বিদায় জানান তিনি। মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বিধাতার ডাকে সাড়া দেন রানা। মাত্র ২২ বছর ৩১৬ দিন সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার হয়ে পাড়ি জমান পরপারে।
রানা আকস্মিক মৃত্যুর খবরে পুরো দলে তখন শোকের ছায়া। বিষয়টা যেন মানতেই পারছিলেন না রফিক-রাজ্জাকরা। তরুণ সাকিব-তামিমরাও তখন মর্মাহত, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ভাইসম বন্ধুকে হারিয়ে তখন শোকবিহ্বল মাশরাফি, গায়ে তখন তার প্রচণ্ড জ্বর। এদিকে ঠিক পরদিন বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ, এমতাবস্থায় মাশরাফিকে বাশারের প্রশ্ন, ‘খেলতি পারবি?’ মাশরাফির উত্তর ‘রানার জন্যি খেলতি হবি।’
যা নিয়ে পরে এক আলাপকালে মাশরাফি বলেছিলেন, ‘ম্যাচের আগের দিন রানা মারা গেলো। আমরা তো দূরে, ওর জানাজাও পড়তে পারছিলাম না। ওর জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবাই আলোচনা করছিলাম এবং এক হয়ে বলেছিলাম আমাদের ম্যাচটা জিততে হবে।’ অর্থাৎ সবাই চেয়েছিল সেদিন শোককে শক্তিতে পরিণত করতে, ম্যাচটি জয় করে রানাকে উৎসর্গ করতে।
পরদিন ভারতের বিপক্ষে মাঠেও দেখা মেলে সেই প্রতিচ্ছবি। ভারতের বিরুদ্ধে টসে হেরে ফিল্ডিং করতে নামা বাংলাদেশ হঠাৎই হয়ে উঠে আগ্রাসী। মাশরাফির নেতৃত্বে বোলিং ইউনিট যেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বেশ শক্তভাবেই চেপে ধরে। ম্যাচের তৃতীয় ওভারেই বীরেন্দর শেবাগের স্ট্যাম্প ভেঙে দেন মাশরাফি। আর দলীয় ২১ রানে সাজঘরে ফেরেন রবিন উথাপ্পা।
উথাপ্পা বিদায়ের পর চার রান যোগ হতেই শচীন টেন্ডুলকারকে ফেরান আব্দুর রাজ্জাক। সেখান থেকে ভারত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, তবে তবে দলীয় ৭২ রানে ‘দ্যা ওয়াল’ খ্যাত দ্রাবিডের প্রাচীর ভেঙ্গে দেন মোহাম্মদ রফিক। যুবরাজ সিং ও সৌরভ গাংগুলী দলকে সসম্মানজনক স্কোর এনে দেয়ার চেষ্টা করেন, তবে সফল হতে পারেননি।
নিজের ৬৬ রানে সৌরভ আউট হলে শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ৩ বল বাকি থাকতেই অলআউট হয় ভারত। মাত্র ১৯১ রানেই ঘুটিয়ে যায় তারা। মাশরাফি একাই ৪টি, রফিক ও রাজ্জাক শিকার করেন ৩টি করে উইকেট।
বোলারদের গড়ে দেয়া ভিতের উপর দাঁড়িয়ে তিন তরুণ; তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে জয় আসে অনায়াসে। তামিম-সাকিব আউট হলেও মুশফিক আর আশরাফুল মিলে জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়েন। বাংলাদেশ লক্ষ্য পেরিয়ে যায় ৪৮.৩ ওভারে ৫ উইকেট হাতে রেখেই। ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন মাশরাফি বিন মর্তুজা।
তরুণ তামিমের ব্যাট সেদিন হয়ে উঠে খাপছাড়া তলোয়াড়। আগ্রাসী তামিম খেলেন ৫৩ বলে ৫১ রানের ইনিংস! তবে আরেক ওপেনার শাহরিয়ার নাফিসকে দ্রুত হারায় বাংলাদেশ, তবে মুশফিকুর রহিম খেলতে থাকেন একপ্রান্ত আগলে রেখেই। তাকে সঙ্গ দেন আরেক তরুণ সাকিব আল হাসান। মাঝে অবশ্য আফতাব আহমেদের উইকেটও হারিয়ে ফেলে টাইগাররা।
তবে মুশফিক-সাকিবের ৮৪ রানের জুটিতে জয়ের দিকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। দলীয় ১৬৩ রানে ৫৩ রান করে আউট হন সাকিব। অধিনায়ক হাবিবুল বাশার দ্রুত ফিরলেও বাকি পথটা আশরাফুলকে সঙ্গে নিয়ে সামলে দেন মুশফিক, তিনি অপরাজিত থাকেন ৫৬ রানে। সেই সাথে রচিত হয় বাংলার ক্রিকেটের এক মহাকাব্য।
তারিখটা মনে আছে তো? হ্যাঁ, আজই সেই দিন। ১৬ বছর আগে আজকের এই দিনেই অভিজ্ঞ মাশরাফি আর তরুণ তামিম, সাকিব আর মুশফিকের হাত ধরে প্রথমবার ভারত বধ করে টাইগাররা! যেই জয় কেবল মানজারুল ইসলাম রানার, না থেকেও যেই জয়ের নায়ক তিনি।