রমজান উপলক্ষে দেশে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেসব পণ্যের সরবরাহে আর কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর।
সংস্থাটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বিবিসিকে বলেছেন, রমজান মাসের পরেও এসব পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না।
পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, রোজায় চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের ব্যাপক সরবরাহ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু পণ্যের দামও কমেছে।
আমদানিকারকরা অবশ্য বলছেন, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সংকট এবং এলসি খোলার বিষয়ে এখনো কিছু কিছু সমস্যার মুখে পড়ছেন তারা।
রমজান মাসে বাংলাদেশে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- খেজুর, ছোলা, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি।
এর মধ্যে পেঁয়াজ ও ডাল কিছু পরিমাণে দেশে উৎপাদিত হলেও বাকি পণ্যগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জের ধরে গত বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশের বাজারে এসব পণ্য বিশেষ করে ভোজ্যতেলের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত বছরের এপ্রিল থেকে জ্বালানি, শিশুখাদ্য, ওষুধের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্যের আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল। এরপর আরো কয়েক দফায় বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিও কঠোর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর জের ধরে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেও বাজারে রমজান উপলক্ষে চাহিদা বাড়ে এমন বেশিরভাগ পণ্যেরই ঘাটতি থাকার কথা জানা যায়। যদিও সরকার তখনো এই ঘাটতির কথা অস্বীকার করেছিল।
‘ঘাটতি নেই’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, রমজান মাসের সব পণ্যের সরবরাহ ঠিক রয়েছে এবং এগুলোর পর্যাপ্ত মজুদও রয়েছে।
এর আগে পণ্য ঘাটতির যেসব বিষয় ছিল সেগুলোর সমাধান করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পণ্য আমদানির বিষয়ে কোনো বাধা নেই।
তিনি বলেন, এর আগে পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজের সংকট, এলসি খোলা নিয়ে সমস্যা- এগুলো এরইমধ্যে সমাধান হয়ে গেছে।
এ কারণেই ভোজ্যতেলের দাম কমেছে বলে জানান তিনি। উদাহরণ হিসেবে বলেন, এক লিটার তেলের যে বোতলের দাম ২৫০ টাকা ছিল সেটি এখন ১৭৮ টাকায় নেমে এসেছে।
অবশ্য বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ ফেব্রুয়ারি বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমার কারণেই স্থানীয় বাজারেও দাম কমেছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া তেলের যে মজুদ আছে তা দিয়ে প্রায় আড়াই মাসের মতো চলবে বলেও জানানো হয়।
চিনির বাজার বেশ কিছুদিন ধরে গরম থাকলেও সফিকুজ্জামান বলেন, ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকার চিনি আমদানির উপর থেকে শুল্ক পাঁচ শতাংশ কমানোর কারণে চিনির দামও কেজিপ্রতি কিছুটা কমবে। প্যাকেটজাত চিনি কেজিপ্রতি ১১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানা যায়।
‘আমাদের যেটা ফিক্সড ডিউটি ছিল রিফাইন্ড সুগারের ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ টনে ৬ হাজার টাকা এবং র সুগারের ক্ষেত্রে ৩ হাজার টাকা, আর এসডি (নিয়ন্ত্রণ শুল্ক) ছিল ৩০ শতাংশ ওখানে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে।’
‘আমার ধারণা, চিনি নিয়ে যে একটু শঙ্কা ছিল সেটিও কেটে যাবে,’ বলেন তিনি।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার ঢাকার বাজারে চিনি প্রতিকেজি ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চিনির চাহিদা বছরে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। রোজায় এই চাহিদা তিন লাখ টনের মতো। দেশে উৎপাদিত হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন চিনি।
ছোলা ও খেজুরের বিষয়ে ভোক্তা অধিদফতর বলছে, রোজার জন্য যে চাহিদা রয়েছে তার পুরোটাই দেশে রয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এগুলোর দাম কিছুটা বাড়তি থাকার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের দাম বৃদ্ধিকে তুলে ধরা হয়।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার ঢাকার বাজারে ছোলা মানভেদে ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এই দাম কমপক্ষে ১০ শতাংশ বেশি।
‘ভারত থেকে পণ্য আসছে’
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চিনি, তেল আর গমের পাইকারি ব্যবসা করেন এমন একজন ব্যবসায়ী জানান, চিনি আর তেলের পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ রয়েছে।
সয়াবিন তেল মণপ্রতি পাইকারি বাজারে ৬ হাজার ৫০০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৬ হাজার ৭০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর পাম ওয়েল খুচরা বাজারে মণপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে পামওয়েল কেজিপ্রতি ১৩৪ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
চিনিও পর্যাপ্ত আছে উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যবসায়ী জানান, পাইকারি বাজারে চিনি প্রতি মণ ৩ হাজার ৯২০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার ৯৪০টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে ৪ হাজার ১০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
দেশে এরইমধ্যে নতুন চিনি উৎপাদিত হওয়ার পর সেগুলো বাজারে এসেছে। এ বছর ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
এছাড়া ভারত থেকে চিনি আসার কারণেও চিনির দাম কিছুটা কমেছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী। গত ১৫-২০ দিন আগে থেকে তারা ভারতীয় চিনি বাজারে বিক্রি করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
তবে এখনো আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য কিনতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে অনেক সময় ঝামেলা হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জে ছোলা এবং বিভিন্ন ধরনের ডাল ও মশলার পাইকারি ব্যবসা করেন আজিজুল হক। তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে বাজারে ছোলার ঘাটতি থাকলেও এখন কোনো ঘাটতি নেই।
ভারতীয় ছোলায় বাজার ছেয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানভেদে বিভিন্ন ছোলা মণপ্রতি অন্তত ২০০ টাকা করে কমেছে।
দেশে তেমন কোনো ছোলা উৎপাদিত হয় না উল্লেখ করে আজিজুল হক বলেন, বেশিরভাগ ছোলাই অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হয়। আর কিছু আসে বার্মা বা মিয়ানমার থেকে। তবে মিয়ানমার থেকে আনা ছোলার দাম বেশি বলে জানান তিনি।
এর আগে ভারত থেকে কখনো ছোলা আসেনি উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘তানজানিয়া থেকে কম দামে কিনে এনে ভারত আমাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছে।’
এই ছোলা বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ২ হাজার ৯০০ টাকা করে।
এলসি সমস্যা শেষ?
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে আমদানির জন্য এলসি খোলার বিষয়গুলো সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমদানিকারকরা বলছেন, এলসি খোলা নিয়ে এখনো বিভিন্ন ব্যাংকে নানা জটিলতার মুখে পড়ছেন তারা।
পাইকারি ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা ব্যাহত হচ্ছে।
বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ডাল, সরিষা, গম আমদানি করলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানি করতে পারেননি তারা।
ডলারের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে এক বছর বা ১৮০ দিন আগে এলসি খোলার কথা। এছাড়া এলসি খুলতে গেলে ১০০ ভাগ মার্জিন চাওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ১০০ ভাগ মার্জিন দিয়ে আসলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আনা সম্ভব নয়।
এলসি মার্জিন হচ্ছে, কোনো পণ্য আমদানি করতে হলে গ্রাহককে পণ্যমূল্যের একটি অংশ ব্যাংকে জমা দিতে হয় যাকে এলসি মার্জিন বলে। এটা ব্যাংকের সাথে গ্রাহকের ব্যবসায়িক সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
তবে এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রমজান উপলক্ষে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মশলা, চিনি ও খেজুরের মতো আটটি পণ্যের আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিনের হার ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ন্যূনতম রাখার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে ডালের মতো পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে তুলনামূলক কমেছে বলে জানিয়েছেন এই আমদানিকারক। তবে সেটি এখনো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যায়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তার মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তার মাত্রা এতই নগণ্য যে এর প্রভাব দেশীয় বাজার পর্যন্ত আসবে না। এ পেছনে রয়েছে নানা কারণ। একদিকে ডলারের দাম উঠানামার বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যাংকের নানা ধরনের নতুন চার্জ আরোপের বিষয়।
সূত্র : বিবিসি