শেন ওয়ার্ন-মুশতাক-ম্যাগগিল-মুরালির ঘূর্ণি মায়াজালে বিস্মিত হয়েছেন? আকরাম-আখতার-ওয়াকারের ধেয়ে আসা অগ্নিগোলা দেখেছেন? ব্রেট লি-স্টেইন জনসন-মালিঙ্গার-নিখুঁত ইয়ার্কার চোখে ভাসে? এমব্রোস-ওয়ালশ-আন্দ্রে-নেলরা কি ভয় ধরা বাউন্সারে কল্পনায় আসে? ম্যাকগ্রা-পোলক-ডোনাল্ডের মহা প্রলয়ে কি কম্পিত হয়েছেন? ভাস-বিপস-এডামসের বিষাক্ত স্পেল অবাক অবলোকন করেছেন?
তবে তাদের প্রতিরোধে আপনার ভাবনায় ব্যাট হাতে কে আসবে? কে রুখবে তাদের অপ্রতিরোধ্যতা? স্মৃতি মন্থন করে ফিরে আসবেন আপনি একটি নামে, শত কোটি ভারতবাসীর প্রত্যাশার পাহাড় নিয়ে শতকের শতক মাইলফলক উন্মোচন করা, ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ঈশ্বরে’! হ্যাঁ শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হয়ে পাকিস্তানের মাটিতে ব্যাট হাতে। ওয়াকারের বলে স্বীয় নাক রঞ্জিত করে যার উত্থান। কাদিরের ওভারে চার ছক্কা হাঁকিয়ে যেনো রাজার আত্মপ্রকাশ। ক্রিকেটের ডন ডনের প্রশংসা- ‘ছেলেটা তো আমার মতো!’
‘মহারাজা, তোমারে সেলাম
সেলাম, সেলাম…’
শচীন টেন্ডুলকার নামটা স্মরণে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় কুর্নিশ জানাতে সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার এই বিখ্যাত গানটার এই লাইন অপেক্ষা ভালো আর কিইবা হতে পারে! তিনি তো সত্যিই মহারাজা। তিনি ক্রিকেটের মহারাজা। তিনি বাইশগজের মহাপরাক্রমশালী মহারাজা। যে রাজার প্রভাব-প্রতিপত্তি গোটা বিশ্বজুড়ে। এমন একজন রাজার তরে কুর্ণিশ জানাতে দ্বিধার কি কোনো সুযোগ আছে?
যতদিন ব্যাটটা তার খাপখোলা ছিলো, ততদিন তিনি ক্রিকেটের বাইশ গজের রাজ্যটাকে শাসন করেছেন নিজের মতো করে। অভিজ্ঞ শিল্পীর ন্যায় ওই সবুজ ক্যানভাসে একেঁছেন ব্যাটের আল্পনায় মুগ্ধতা ছড়ানো সুন্দর সব চিত্র। বাইশ গজে হাজারও স্মৃতি, গল্প, বা উপন্যাসের রচিয়তা তিনি। তিনি কীর্তিগাঁথার পাহাড়ের অধিপতি। হয়তো পূর্বের কীর্তিতে নতুনত্ব এনেছেন, নয়তো নিজেই নতুন কীর্তির সূচনা গড়েছেন।
তার নামটাই যেন একটা আবেগ, একটা মোহ। শচীন একটা বিস্ময়, একটা বিলাসিতা। শতকোটি ভারতবাসীর প্রত্যাশার চাপ কাঁধে নিয়েও সগৌরবে উঁচু শিরে ছুটে চলা এক আভিজাত্যের নাম শচীন। যার নাম মানেই ইতিহাস, যার নামেই অসংখ্য সব রেকর্ডের ঝড়োচ্ছ্বাস। পরিসংখ্যানেই তার পরিচয় ফোঁটে, আবার পরিসংখ্যান তার জন্য শুধুই সংখ্যা বটে।
তবুও পরিসংখ্যান বিবেচনায় অসংখ্য রেকর্ডের মাঝে শচীনের অনবদ্য ১০টি রেকর্ড হলো—
-আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে শচীনেরর রান সংখ্যা ৩৪,৩৫৭। ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রানও তার দখলে।
-আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ শতক হাঁকানো ক্রিকেটার তিনি। বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে শতকের শতক হাঁকিয়েছেন তিনি। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে শচীনের সেঞ্চুরি আছে ১০০টি।
-একদিনের ক্রিকেটে ১০ হাজারের অধিক রান (১৮,৪২৬) আর শতাধিক (১৫৪টি) উইকেট শিকারী একমাত্র ক্রিকেটার তিনি।
-বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্বিশতক হাঁকান শচীন। (২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে)
-ভারতের হয়ে সবথেকে কম বয়সে (১৭ বছর ৩ মাস ১৭ দিন) টেস্ট ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন শচীন।
-ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র তিনি ২০০টির বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন।
-একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ টেস্ট ম্যাচ খেলার রেকর্ড তার৷ একই রেকর্ড আছে ওয়ানডেতেও। এই ফরম্যাটেও সর্বোচ্চ ৪৬৩ ম্যাচ খেলেছেন তিনি।
-বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি (২,২৭৮)। এক আসরের সর্বোচ ৬৭৩ রানও তার দখলে।
-একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৪ বার ‘ম্যান অফ দ্য সিরিজ’ও হয়েছেন শচীন।
-একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৬২ বার ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ হবার রেকর্ডও শচীনের দখলে।
শচীন এমন আরো হাজারো রেকর্ড গড়েছেন, ক্রিকেটে যা সবার কাছে স্বপ্ন! তাকে নিয়ে বলতে গেলে ফুরিয়ে যাবে বিশেষণ-উপমা। চায়ের কাপে ঝড় ওঠবে, হয়তো সুর তুলবে কলম। একদিন সব থেমেও যাবে। কিন্ত থামানো যাবে না তাকে নিয়ে লিখতে থাকা সেই কলম, লেখা হতেই থাকবে তার কীর্তময় সব গল্প।
দীর্ঘ ২৪ বছরের ঘূর্ণাবতে দিশেহারা করেছেন ঘূর্ণির মায়াজাল, অগ্নিগোলাগুলো সামলে করেছেন পগারপার। মরন ছোবল ইয়ার্কার রুখে দিয়েছেন অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্ততায়। ১৫ নভেম্বর ২০১৩ যবে এই ঝড় থামে কালের স্রোতে বাস্তবতা মেনে ততদিন ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে, প্রতিটি পাতায় ঠায় নিয়েছেন স্বর্ণাক্ষরে ‘গড অফ ক্রিকেট’ খেতাবে।
১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঔপন্যাসিক বাবার ঘরে, মহাউপন্যাস আর মহাকাব্যের উপমার আতুঘর হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিলেন, ক্রিকেটে ‘বিধাতা’র দেয়া সেরা উপহার শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।
শুভ জন্মদিন শচীন! শুভ জন্মদিন মাস্টার!!