শেখ হাসিনা ভারত থাকলে, দু’দেশের সম্পর্ক অবনতি ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন হবে

0
12

রতন তালুকদার : জুলাই-আগস্ট ছাত্রদের আন্দোলনে শেখ হাসিনার ঘর ভেঙে যায়। তিনি ভারতে পালিয়ে গিয়ে নিজের জান বাঁচান। তার নিজের আত্মীয়-স্বজনও দেশের বাইরে নিরাপদে। কাউয়া কাদের সহ তার দলের চোর ডাকাতগুলি কেউ পলাতক, কেউ ভারতে রাজার হালে। ওরা লুট করা অর্থের বিনিময়ে দেশে-বিদেশে আত্মগোপন করেছে।

দেশের ভেতর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন বিপন্ন। দেশের ছবিটি কী? চারদিকে নৈরাজ্য, খুন, ধর্ষণ। বাড়তি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর এই পবিত্র রমজান মাসেও সীমাহীন অত্যাচার, জান-মালের উপর আঘাত। সংখ্যাগুরু মুসলিমরা এসব বিশ্বাস করে না। তারা এখনো দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গীত গায়! বড়জোর বলে হিন্দু যারা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী ছিলো তাদের উপর সামান্য আঘাত হয়েছে! রমজান মাসেও গত দু’দিনে উত্তরের গাইবান্ধা থেকে দক্ষিণের ঝালকাঠি পর্যন্ত আধা-ডজন সংখ্যালঘুর বাড়ি-ঘর, মন্দিরে হামলা হয়েছে। ঐসব হতদরিদ্র মানুষগুলির অপরাধ ওরা “নৌকায়” ভোট দিয়েছিলো।

দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাত মাস পেরিয়ে আট মাসের শিশুর মতো হামাগুড়ি দিচ্ছে। কই হালচাল তো “যেই লাউ সেই কদু”, দেশটি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

শেখ হাসিনা প্রতিবেশী ভারতে নজিরবিহীন সুরক্ষায় এবং কঠোর গোপনীয়তায় অতিথির আসনে বসে বসে স্বপ্ন দেখছে “আবার টুপ করে দেশে ডুকে যাবে”! শেখ হাসিনা তার দলবল নিয়ে ভারতে নিরাপদ থাকলেও দেশের নিরীহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আতংকে আছে, দিনদুপুরে যেমন তেমন, রাতের আঁধারে তাদের ভয়াল আর্তনাদ কে শোনে!

শেখ হাসিনা যতদিন ভারতে থাকবে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন অব্যাহত থাকবে। এর আগেও শেখ হাসিনার আমলে গত ষোলো বছর ওদের উপর সীমাহীন বৈষম্য, অত্যাচার ও উপসনালয়ে ভাংচুর হয়েছে। প্রতিকার হয়নি, খোদ শেখ হাসিনাও স্বীকার করেনি বরং তিনিও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঢোল জোরেসোরেই বাজাতেন! হিন্দু সম্পত্তি দখলে আওয়ামীলীগ ছিল চ্যাম্পিয়ন, অপ্রতিরোধ্য।

কোটা বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর দেশের মানুষ আনন্দে উল্লাস করেছিল। তবে ভারতে হাসিনার আশ্রয় বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী মেনে নেয়নি। সেই থেকে বরং বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ ভারতের প্রতি আরও বেড়ে তৃণমূল পর্যন্ত ভারত বিরোধিতা বিস্তার করে। এখন বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব যেন শেখ হাসিনা নয়, ভারতেরই সব দোষ! গত ১৬ বছর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারকে ভারত আগলিয়ে রাখে, শুধু এ কারণেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভেতর ভারত বিরোধী ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয় যার বিস্ফোরণ ঘটে জুলাই অভ্যুত্থানের পর।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তার প্রতিবেশীদের সাথে সুখকর নয়। চিরশত্রু পাকিস্তান ও মহাশক্তিধর চীন বাদ দিলে ভারত তার প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ সহ তার পেটের ভেতর বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক আচরণ সমঝোতামূলক ছিলো না। এ কারণেই গত কয়েক বছর ধরে এই বিশ্বশক্তি ভারত তার প্রতিবেশীদের নিয়ে ভুগছে!

বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণ, বাণিজ্যের বৈষম্য, মাঝে মাঝে দাদাগিরিসহ শেখ হাসিনা সরকারকে লালন-পালন বাংলাদেশের মুসলমানরা সুনজরে দেখেনি বরং তারা অতিমাত্রায় ক্ষেপে উঠে।

বাংলাদেশের প্রতি ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ ছিল একতরফা, একগুঁয়েমি ও দৃষ্টিকটূ। টানা ষোলো বছর একটি দলকে অন্ধের মতো সমর্থন, বাংলাদেশের মানুষকে আরও ভারতবিরোধী করে তোলে। ভারতের প্রতি বিদ্বেষ খেলার মাঠ পর্যন্ত গড়ায়, গেলো বছর ভারত-অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে ভারতের হারে বাংলাদেশে নজিরবিহীন উল্লাস দেখা গেছে!

ভারতের কূটনীতি ও বাংলাদেশ সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিলো আপত্তিকর। বাংলাদেশের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক হবে জনগণ-টু-জনগণ, দেশ-টু-দেশ। কোন বিশেষ দল বা নেত্রীর সাথে সম্পর্ক কূটনৈতিক নীতিমালায় চলে না। বাংলাদেশে যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে ভারতকে সেই দলের সাথেই সম্পর্ক করতে হবে। সরকারের সাথে সরকারের সম্পর্ক এমনি হয়। একজন নেতার সাথে অন্য দেশের নেতার সম্পর্ক বন্ধুত্ব হতেই পারে। কিন্তু বিষয়টি রাষ্ট্রের উপর, দেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়াও শিষ্টাচার নয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগই তো একমাত্র দল ছিল না। সেখানে বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি, যাঁর নেত্রীও তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী। ভারত এই বিষয়টি পাশ কাটায় কোন কূটনৈতিক যুক্তিতে।

তারপরও কথার প্রেক্ষিতে কথা উঠে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার “র” সুনাম বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশে কথিত “র” খবরদারিও মানুষ মেনে নেয়নি। বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সবসময়ই তৎপর ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এবার শেখ হাসিনার পতনের কারণ সমূহ “র” এন্টানায় ধরা পড়েনি কেন? ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কি জানতো না, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে শূন্যের কোটায়?

শেখ হাসিনার মর্মান্তিক পরাজয় ও লজ্জাজনক পলায়নের পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের তিক্ততা শুধু বাড়েনি বরং উদ্বেগজনক। এই সম্পর্ক তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হলে দু’দেশের জন্যই অশনি সংকেত!

যতদিন শেখ হাসিনা ভারতে থাকবে ততদিনেই বাংলাদেশে মানুষের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বলবে। আর এই আগুনে দগ্ধ হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। এবং বাড়বে ভারত বিরোধিতা।

পৃথিবীতে অনেক দেশে ভারতের প্রভাব আছে। শেখ হাসিনাকে তৃতীয় কোন দেশে স্থানান্তর ভারতের জন্য দুরূহ নয়। যত দ্রুত সম্ভব শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে বিদায় করলে দুটি দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশিীলতা আসবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরও উপর নির্যাতন কিছু হলেও লাঘব হবে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও বাস্তবতাকে হিসেবে এনে ভারত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিক, শেখ হাসিনা জন্য অন্য কোন দেশে নিরাপদ ডেরা খোঁজে বের করা ভারতের জন্যই মঙ্গলজনক। কারণ একজন পতিত স্বৈরাচারের জন্য দু’দেশের সম্পর্ক উচ্ছন্নে যেতে পারে না।

ভারতের মোদি সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখুন, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাঁচান!

লেখকঃ রতন তালুকদার ,নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জন্মভূমির সম্পাদক ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here