top-ad
৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১
banner
৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪
২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১

শেষ মুহূর্তেও প্রত্যাশিত কেনাবেচা নেই


ঈদের বাকি মাত্র এক সপ্তাহ। এই সময়ে মানুষের ব্যস্ততা থাকে শপিংমলগুলোতে। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। ক্রেতা কম থাকায় শপিংমলেও নেই জমজমাট ব্যস্ততা। বিক্রেতারা দিনের অধিকাংশ সময় অলস সময় পার করছেন। দিনের নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা বেচাকেনা হলেও তাতে সন্তুষ্ট নন তারা। বিক্রেতারা বলছেন, এই বছর ঈদের আগে বিক্রি কমেছে অর্ধেক। ক্রেতারা দরদাম করলেও কিনছেন কম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে পোশাকের মার্কেটে।
পোশাকের জন্য ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় মার্কেট মৌচাক। শিশু থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ সবার সব ধরনের পোশাকই পাওয়া যায় এখানকার মার্কেটগুলোতে।
পাঞ্জাবির জন্য মৌচাকের আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের ব্যাপক সুনামও রয়েছে। তবে ক্রেতা খরায় বসে বসে সময় পার করছেন সেখানকার দোকানিরা। তুলি নামের একটি দোকানের বিক্রেতা মো. রিফাত। তার দোকানে ৭০০ টাকা থেকে শুরু করে প্রায় ৭ হাজার টাকা দামের পর্যন্ত পাঞ্জাবি রয়েছে। তবে চাহিদা সবচেয়ে বেশি ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবি। তিনি জানান, চলতি বছরের মতো আর কখনো ঈদের বাজার এত মন্দা ছিল না। গত বছরো এরচেয়ে বিক্রি অনেক বেশি ছিল। এবার পুরো মার্কেটেই ক্রেতা কম। রোজার শেষ ১০ দিনেও বেচাবিক্রি প্রত্যাশিত না। রিফাত বলেন, আমরা এখন সবচেয়ে কম লাভে বিক্রি করছি। আগের রোজার চেয়ে এবার ৬০ শতাংশ বিক্রি কমেছে।
আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স থেকে অনেকে জাকাতের পাঞ্জাবিও কিনতে আসে। তবে এ বছর সেই ক্রেতার সংখ্যাও কমেছে বলে জানান রিফাত। যারা কিনতে আসছে তারা আগের চেয়ে পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। রিফাত বলেন, আগে যে জাকাতের জন্য ১০০ থেকে ১৫০ পিস পাঞ্জাবি কিনতো সে এখন ৩০ থেকে ৫০ পিস কিনে। কারণ মানুষের কাছে টাকা নাই।
মৌচাক মার্কেটের স্বরলিপি ফ্যাশনে বাচ্চাদের ফ্রক, পার্টিফ্রক, কটনফ্রক, গাউনসহ বাহারি পোশাক বিক্রি হয়। তবে বাচ্চাদের পোশাকের দোকানের ভিড়ও আগের চেয়ে কমেছে অনেক। স্বরলিপি ফ্যাশনের মো. আজাদ বলেন, এখন মানুষ কেনাকাটা না করতে পারলে বাঁচে। মানুষের হাতে টাকা নাই। ঈদের আগে বেচাকেনা মন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, সারাদিন দোকানে ৪-৫ জন কর্মচারী কাজ করে। সে হিসেবে যে বিক্রি হওয়ার কথা তা হয় না। আগের বছরের চেয়ে অর্ধেক কমছে বিক্রি। দামে বনিবনা না হওয়ায় ক্রেতাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় বলেও জানান এই বিক্রেতা। মৌচাক মার্কেটের আলিফ শাড়ি বিতানে এক হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা দাম পর্যন্ত বিভিন্ন শাড়ি রয়েছে। দোকানের বিক্রেতা তরিকুল ইসলাম বলেন, এবারের ব্যবসা একেবারে ভিন্ন। অর্থনৈতিকভাবে মানুষ চাপে আছে। আমরা টেনশনে আছি ঈদের আগে পার্টিকে (পাওনাদার) টাকা দিতে পারবো কি না। আমাদের ব্যবসা না থাকলেও তাদের টাকা শোধ করতে হবে। যেখানে অন্যদিনে ২০ রোজার পর আমরা দৈনিক এক-দেড় লাখ টাকার শাড়ি বিক্রি করতাম এখন সেখানে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে না। ঈদের মৌসুমে এটা কোনো বিক্রির মধ্যেই পড়ে না।
মৌচাকের ফরচুন শপিংমলেও ক্রেতার আনাগোনা কম। গল্প আর আড্ডায় সময় কাটাচ্ছেন বিক্রেতারা। ফ্যাশন জিক নামের দোকানে ছেলেদের পাঞ্জাবি, প্যান্ট, শার্ট ও টি-শার্ট বিক্রি হয়। ক্রেতা না থাকায় সেখানেও অলস সময় পার করছেন বিক্রেতারা। ফ্যাশন জিক-এর বিক্রেতা পিপলু বলেন, বিকালে ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা একটু চাপ থাকে। আর ইফতারের পর দুই ঘণ্টা একটু চাপ থাকে। এ ছাড়া মার্কেটে ক্রেতা তেমন থাকে না। ফরচুনের বড়গাছিয়া দোকানের মো. সিকান্দার বলেন, এবার নিত্যপণ্যের দাম বেশি। মানুষ কীভাবে ঈদের পোশাক কিনবে। আপনি নিজেই দেখেন মার্কেটে কোনো মানুষ নাই। আমরা বসে আছি। আর অন্য বছর এই সময়ে দম ফেলার সময় থাকে না।
মৌচাকের এসব মার্কেটের চেয়ে ঢাকার অভিজাত শপিংমল বসুন্ধরা সিটিতে ক্রেতাদের আনাগোনা কিছুটা বেশি। তবে ঈদের হিসেবে তা বেশি নয় বলে জানান এখানকার বিক্রেতারা। শিশুদের পোশাক থেকে শুরু করে পাঞ্জাবি, ছেলেদের প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট, নারীদের ড্রেস, শাড়িসহ নামি-দামি ব্র্যান্ডের সব পোশাকই পাওয়া যায় এখানে। তবে হাতেগোনা কয়েকটা নামকরা ব্রান্ডের বাইরে বেশির ভাগেই ক্রেতার সমাগম কম। এখানকার বিক্রেতারাও জানিয়েছেন ঈদের আগে বিক্রি কম হওয়ার কথা। তারা বলছেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে প্রত্যাশিত বিক্রির চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ বিক্রি কম হচ্ছে এখন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে ক্রেতা বসুন্ধরা সিটিতে আসতো তারা আসা কমিয়ে দিয়েছেন। যারা আসছেন তাদের বাজেটের মধ্যে পোশাক কিনতে পারছেন না। তাই তারা ঘুরে ঘুরে দেখে চলে যাচ্ছেন। বসুন্ধরা সিটির নেক্সাস দোকানের ইনচার্জ ডালিম সিকদার জানিয়েছেন, এবার বিক্রি ভালো হচ্ছে না। মার্কেটে ক্রেতার চাপ কম। বিক্রি প্রত্যাশার চেয়ে অর্ধেকে নেমেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব এখন মার্কেটে বোঝা যাচ্ছে। পোশাকের দামও নানা কারণে বেশি। আগে যে পোশাক ২ হাজার টাকা বিক্রি করতাম তা এখন ২৬০০ টাকা দাম। কিন্তু ক্রেতাদের তো আয় বাড়ে নাই। সব জায়গায় একই অবস্থা। নিউমার্কেটে আমাদের দোকান আছে। সেখানেও বেচাকেনা নাই।
মেয়েদের সব ধরনের পোশাক বিক্রি হয় বসুন্ধরার ভেইল নামের দোকানে। সেখানকার বিক্রেতা মো. সবুজ বলেন, রোজার শেষের ১০ দিন দম ফেলার সময় পেতাম না আগে। আর এখন নিরিবিলি। মানুষের কাছে শপিং করার জন্য যে টাকা দরকার সেটা নাই। তাই মার্কেটেও ক্রেতা নাই। অন্য সময়ে আমরা একটা জামা ২৫০০ টাকা বিক্রি করতাম। এখন তা ১৮০০ টাকাতে হলেও বিক্রি করছি। কারণ ঈদের আগে পাওনাদারের টাকা শোধ করতে হবে। তাই কমে হলেও বিক্রি করছি। তারপরও অনেক পণ্য এখনো দোকানে সাজানো। বিক্রি হচ্ছে না। জেন্টেল পার্কের শিপলু বলেন, মার্কেটে ক্রেতা কম দেখা যাচ্ছে। অনেকের মার্কেটে এসে কেনার সময়ও নেই। কিছু ক্রেতা অনলাইনেও শিফট হয়েছে।
ধানমণ্ডিতে অবস্থিত রাপা প্লাজা গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। দোকাগুলোয় বিরাজ করছে সুনশান পরিবেশ। ক্রেতার অপেক্ষায় রয়েছেন দোকানিরা। তারা নিজেরাই জামা-কাপড় বের করে দেখছেন, আবার রেখে দিচ্ছেন। কয়েকটি দোকানে দু’চার জন ক্রেতা থাকলেও তারা দেখে শুনে ফিরে যাচ্ছেন। এখানকার বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ডিজাইনের ও মানের পোশাক সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় রয়েছেন। পাঞ্জাবি থেকে শুরু করে প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট, শিশুদের ড্রেস, নারীদের থ্রি-পিস, শাড়িসহ বিভিন্ন পোশাক শোভা পাচ্ছে দোকানগুলোতে। এসব দোকানে দর্শনার্থীদের ভিড় ও বেচাকেনা অনেক কম। মূলত পোশাকের অতিরিক্ত দামের কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন ক্রেতারা। বিক্রেতারা বলছেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পোশাকের দাম বেড়েছে। যেটি অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তাই বিক্রি কমে গেছে।
রাপা প্লাজার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত রেডিমেড পণ্যের দোকান ক্যাথেই’র স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন বলেন, বেচাকেনা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আজকে ২২ রমজান, ২০ রমজান থেকে দেখছি মার্কেটে কাস্টমার নেই বললেই চলে। ৪ তারিখ থেকে মনে হয় না মার্কেটে এই লোকগুলো থাকবে। গত বছরের তুলনায় এই বছরে ৪০ শতাংশ বেচাকেনা কম হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো ভালো রেসপন্স পাচ্ছি না। শুধু শুক্র-শনিবারে কাস্টমার হয়েছে। মানুষের মধ্যে ঈদের কোনো আমেজ নাই। পোশাকের দাম যাই হোক, কাস্টমার তিনভাগের একভাগ দাম বলে। সবাইকেই তো বাঁচতে হবে, আমাদের তো কিছু প্রোফিট করতে হবে। ঈদের জন্য ব্যবসায়ীরা বসে ছিলেন, এখন বেচাকেনা না হলে আমার মনে হয় না কোনো ব্যবসায়ী টিকতে পারবে।
ছেলেদের পাঞ্জাবি, শার্ট ও প্যান্টের দোকান বিগ সেলের পরিচালক আজগর আলী বলেন, আমার ১২টা দোকান ছিল। করোনার কারণে বন্ধ হতে হতে এখন মাত্র একটা দোকান আছে। এখন বাজে সাড়ে তিনটা, কেবল একটা পোশাক বিক্রি করে বিসমিল্লাহ করেছি। মানুষের খাদ্য কিনতেই তো অনেক টাকা যাচ্ছে। এই মার্কেটে উচ্চবিত্তের থেকে মধ্যবিত্তের আনাগোনা বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাই কাটছাঁট করে চলছে। যেখানে দুই কেজি কিনতো সেখানে এক কেজি কিনছে। আগে অনেকে গিফট দিতো, এখন সেটাও কমায় দিছে। যেটা না হইলেই না, শুধু সেইটাই কেনে। তিনি বলেন, এই দোকানে আগে ৫ জন লোক থাকতো, এখন আমরা ২ জন আছি। গত ঈদে আমি একটা পিচ্চি রাখছিলাম, এবার ওকে আমি রাখিনি। কারণ আমি জানি ওকে রাখলে বেতন দিতে পারবো না।
রাপা প্লাজার তিনতলায় অবস্থিত মেসার্স মোল্লা সিল্কের স্বত্বাধিকারী মো. শফিউল ইসলাম বলেন, দুই মাস হলো এই মার্কেটে দোকান দিয়েছি। আমাদের সেল নাই বললেই চলে, একদমই ভালো না। রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মার্কেট খোলা থাকে। শুধু বিদ্যুৎ বিল গুণতে হচ্ছে। ঈদের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। কিন্তু মার্কেটে কোনো কাস্টমার নেই। সব দোকানেই একই অবস্থা।
মহিলাদের থ্রি-পিসসহ যাবতীয় পণ্যের দোকান সিন্ডনের সেলসম্যান লিটন বলেন, কাস্টমার অনেক কম। যেমন বেচাকেনা হওয়ার কথা তুলনামূলকভাবে খুব কম। আমাদের তো রেডিমেড আইটেম না, এসব আইটেম যাদের কেনার তারা অনেক আগেই কিনে ফেলেছে। এখন বেচাকেনা নেই বললেই চলে। সন্ধ্যার পরে কিছু কাস্টমার আসে, গিফটের জন্য কিনছে।
টপ টু বটম দোকানের পরিচালক সোহেল হোসেন বলেন, গত রমজান থেকে এবারে তেমন কাস্টমার জমেনি। টুকটাক সেল দিচ্ছি। ঈদের কোনো আমেজ নেই। আজ ২২ রমজান, গত বছর শেষ ১০ দিনে যা সেল হয়েছিল এবার তার ৫০ শতাংশও হয়নি।
এন এম মার্টের স্বত্বাধিকারী নূর মোহাম্মদ জনি বলেন, ঈদ উপলক্ষে এবার আশানুরূপ কোনো সেল হচ্ছে না। গত বছরে যে পরিমাণ সেল ছিল এবার তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

আরো খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

জনপ্রিয় খবর