বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, একটা বড় ভূমিকা ছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই একদিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে, পরবর্তী পর্যায়ে এখানেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে নানাভাবে বাঁধার চেষ্টা করা হয়েছে। কালাকানুন চালু করে এর যে স্বাধীনতাটুকু, এমনকি ইংরেজ আমলে চালু ছিল সেটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপকদের লেখা ও মতামত প্রকাশের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। অন্যদিকে আবার চেষ্টা করা হয়েছে, তাদের প্রলুব্ধ করার। শুধু দেশি সরকার নয়, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও বিশেষ তৎপরতা দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি সৃষ্টির জন্য; সেই শ্রেণি এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরও গড়ে উঠছিল। দুর্বলচিত্ত ও লোভী মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চয়ই ছিলেন। কিন্তু তবু, বিচ্যুতি সত্তে¡ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভূমিকা ছিল জনসাধারণের, অর্থাৎ বাংলাদেশের পক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পাকিস্তানবাদী ছিলেন তারা চুপ করে ছিলেন না, তাদের পেছনে সরকারের সমর্থন ও সহায়তা ছিল, কিন্তু তবু তাদের কাজ দেশের ওপর বড় কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করেছে। ইংরেজরা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবিশ্বাস করত, পাকিস্তানিরা আরও বেশি করত-সংগত কারণেই। অবিশ্বাস করত বলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে তাদের কোনো উৎসাহ ছিল না। চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হলো শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের মধ্যে। সাভারে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার পরিকল্পনা করল, নাম দিল মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। জায়গা করল ঢাকা শহর থেকে দূরে লোকবসতিহীন এক প্রান্তরে। এক সময় চেষ্টা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাকা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। উদ্দেশ্যটার মধ্যে কোনো লুকোচুরি ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে উঠতে দেওয়া হবে না পরিপূর্ণভাবে, তাকে রাখতে হতো জনজীবন থেকে দূরে, কেননা বিশ্ববিদ্যালয় যদি বড় হয়, অনেক হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় যদি শহরের মাঝখানে থাকে, তবে ছাত্র ও অধ্যাপকরা রাজনীতি করবে, অর্থাৎ অধিকারের কথা বলবে, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সভা-শোভাযাত্রা-বিক্ষোভ শুরু করে দেবে। অবিশ্বাস শুধু নয়, ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড একটা ক্রোধ ছিল শাসকদের। যার প্রমাণ পাওয়া গেল তখন, যখন গণহত্যার সূচনাতেই মিলিটারিরা ছুটে এলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এসে ছাত্র-শিক্ষক যাকে পেল হাতের কাছে গুলি করে হত্যা করল, দালান-কোঠাও রক্ষা পেল না। আত্মসমর্পণের আগে আবার তারা অনুচরদের পাঠিয়েছে বেছে বেছে বাংলাদেশের আন্দোলন সমর্থনকারী শিক্ষকদের হত্যা করার জন্য।
শুধু শিক্ষক বলে নয়, গোটা বুদ্ধিজীবী স¤প্রদায়ের প্রতিই আক্রোশ ছিল। হানাদারদের পরিকল্পনা ছিল প্রত্যেক শহরে তারা ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধিজীবী নিধন করে যাবে আত্মসমর্পণের আগে। এবং কাজ তারা শুরুও করেছিল, শেষ করে যেতে পারেনি এটাই যা রক্ষা। এর কারণ বুদ্ধিজীবীদের উসকানিতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চেয়েছে বলে তাদের ধারণা। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী বলে কেউ না থাকুক, থাকুক শুধু সাধারণ মানুষ এটাই তাদের কল্পনার স্বর্গ ছিল, কেননা তাহলে তাদের ধারণা তারা অনাদিকাল ধরে এ দেশে শোষণকার্য অব্যাহত রাখতে পারত। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বুদ্ধিজীবী সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন, অনেক সময় ছিলেন অগ্রবর্তীও।
বাংলার অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ সাধারণ মানুষের সচেতনতাকে অনেকটা অগ্রসর করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ যে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে এটা সবারই জানা ছিল। অর্থনীতিবিদরা সেই সত্যটা আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে ১৯৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে তারা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রে ক্রমশ পঙ্গু হয়ে পড়েছে। সরকার তথ্য বিকৃত করত, অনেক তথ্য বাঙালি অর্থনীতিবিদদের হাতে আসত না, কেন্দ্রীয় অর্থ দপ্তরের উচ্চপদে বাঙালিদের নিয়োগ করা হতো না, তবুও অর্থনীতিবিদরা এটা বুঝেছিলেন, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে দুটি স্বতন্ত্র অর্থনীতি চালু করা প্রয়োজন। শেষ দিকে দুই অঞ্চলের অর্থনীতিকদের মধ্যে মতবিরোধ এত প্রবল হতো, তারা কোনো কোনো ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট প্রদান করতেন। আইয়ুব খান চতুর লোক ছিলেন, দুই অর্থনীতির দাবি তার সময়ই জোরেশোরে উঠেছিল এবং তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, দুই অর্থনীতির পরিণাম দুই পাকিস্তান। আইয়ুব খান এ দাবি স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন ধমক দিয়ে, অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করার হুমকি দিয়ে। কিন্তু তাতে সত্য-অসত্য হয়ে যায়নি, ফাটল জোড়া লাগেনি। ফাটল শুরু হয়েছিল ভাষাকে কেন্দ্র করে, অর্থনীতি সেই ফাটলকে ক্রমশ বাড়িয়ে দিয়েছে, পরিণতিতে শুধু দুই অর্থনীতি বা দুই পাকিস্তান নয়, দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভাষার ফাটলের কথাও আইয়ুব খান জানতেন। পতনের আগে তিনি একবার দুই অঞ্চলের জন্য একটি সাধারণ ভাষা সৃষ্টি করার কথা বলেছিলেন। সন্দেহ নেই, সে কাজ করতে গেলে ফাটল তো বন্ধ হতোই না, বরং আরও বৃদ্ধি পেত।
প্রত্যক্ষ ভূমিকার বাইরে বুদ্ধিজীবীদের অপ্রত্যক্ষ ভূমিকাটাও কম গুরুত্বের নয়। বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম, তাই শিক্ষিতের মর্যাদা বেশি। সম্মান প্রদর্শনের অভ্যাসও এ দেশে পুরোনো। বুদ্ধিজীবীদের তাই এ দেশে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান আছে। সেজন্যই দেখা যায়, বুদ্ধিজীবীদের ওপর যখন আক্রমণ এসেছে, তখন আহত হয়েছে সমগ্র দেশ, বিক্ষোভ প্রকাশ করেছে দেশের সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরুতে ছিল মূলত ছাত্রদের আন্দোলন, কিন্তু যে মুহূর্তে গুলি চলল ছাত্রদের ওপর, গ্রেফতারি পরোয়ানা নেমে এলো শিক্ষকদের ওপর, তখনই অবিশ্বাস্য অল্প সময়ের মধ্যে ছাত্র আন্দোলন লেলিহান গণআন্দোলনে পর্যবসিত হলো। তেমনিভাবে উনসত্তরের আন্দোলন তার চরমরূপ পরিগ্রহ করল সেই মুহূর্ত থেকে, যেই মুহূর্তে খবর প্রচার হলো, মিলিটারিরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোহাকে গুলি করে হত্যা করেছে। ঢাকায় তখন কার্ফু ছিল, কিন্তু ওই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হাজার হাজার মানুষ বের হয়ে এসেছিল রাস্তায়। কেউ তাদের বলেনি বের হয়ে আসতে, ড. জোহাকে তারা জানে না, বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাকুক, কোনো বিদ্যালয়েই যায়নি তাদের অধিকাংশ মানুষ, কিন্তু তবু ড. জোহার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তারা তাদের নিজেদের অপমানকে দেখল-দেখল তাদের নিজেদের অস্তিত্বের ওপর নৃশংস এক আক্রমণকে। ফলে আন্দোলন এমন প্রবল হয়ে উঠল, তার স্রোতে আইয়ুব খান-মোনেম খান ভেসে চলে গেল কোথায়।
উনসত্তরের আন্দোলনের সময় যারা প্রেস ট্রাস্টের সংবাদপত্র দুটির অফিস পুড়িয়েছে, তাদের অনেকেই হয়তো সংবাদপত্র পড়ে না, কিন্তু তারা জানত সংবাদপত্র দুটি তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছিল। অন্যদিকে সরকার যখন যে পত্রিকার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে, তখন সেই পত্রিকাকে জনসাধারণ আদর করে বুকে তুলে নিয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাক সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল সেই সময়ে, যখন তার প্রকাশ নিষিদ্ধ ছিল, যখন তার সম্পাদক কারারুদ্ধ ছিলেন। পুস্তক নিষিদ্ধ করার কাজে সরকারের উৎসাহ ছিল, কিন্তু শেষের দিকে সরকার আর নিষেধাজ্ঞা প্রচার করতে সাহস পায়নি, প্রচার করলেও সে নিষেধাজ্ঞা মান্য করা হয়নি।
১৯৭১-এর গণহত্যা যখন শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিকভাবে বেজেছে যে ঘটনা, সে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ড। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে ছিল এ ঘটনার পর নিশ্চিত জেনেছে, পূর্ণ স্বাধীনতা ভিন্ন অন্য কোনো পথে বাঙালির বাঁচার উপায় নেই।
বুদ্ধিজীবীদের যে অংশ জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকারের তাঁবেদার হিসাবে কাজ করেছে, তাদের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। আটষট্টি সালে অগ্রগতির দশ বছরের গুণকীর্তন করে যখন প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে একটি করে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছিল, যখন প্রতিদিন মস্ত মস্ত ছবি ছাপা হচ্ছিল আইয়ুব খানের, তখন সেই সমারোহ যেমন করে বিদ্বিষ্ট করে তুলছিল পাঠকদের, তেমনিভাবে প্রলুব্ধ ও স্তাবক বুদ্ধিজীবীদের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার বর্ধিষ্ণু সমারোহও ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল মানুষের মনে। বিশেষ করে আইয়ুব রাজত্বকালে, কেননা সেই কালেই উদ্যোগ-আয়োজনটা বেড়েছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ মীরজাফরদের জন্ম যেমন দিয়েছে, তেমনি তাদের ঘৃণা করতেও কার্পণ্য করেনি।
তারচেয়েও বড় কথা এ সুবিধাভোগী ও ক্ষেত্র বিশেষে
নির্বোধ, বুদ্ধিজীবীদের লেখায়-বক্তৃতায় ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। তারা যা ভালো বলেছেন, জনসাধারণ নিশ্চিত জেনেছে, তা মন্দ না হয়ে যায় না। তারা যার পক্ষে থেকেছেন, জনসাধারণ তার বিপক্ষে গেছে। অবশ্য এরা পক্ষে যত না বলেছেন, বিপক্ষে বলেছেন তার চেয়ে বেশি; কেননা এদের প্রধান চরিত্র হচ্ছে বর্জনবাদীর। এরা বলেছেন, ইকবাল অতি মহৎ কবি, বাংলাদেশের মানুষ সেই মহত্ত¡ দেখতে পায়নি। এরা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথকে বর্জন কর। যত বলেছেন এই কথা, তত জনপ্রিয়তা বেড়েছে রবীন্দ্রনাথের, তত বেশি দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের মানুষ আঁকড়ে ধরেছে রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ কবি থাকেননি, তিনি জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছেন, তার গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। এরা বলেছেন, বাংলা ভাষাকে ইসলামি কর। যত বলেছেন, তত বেড়েছে সমগ্র বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের প্রীতি ও আকর্ষণ। হরফ বদলানোর পরামর্শ সবাই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এরা বলেছেন, নজরুল ইসলামের সংস্কার আবশ্যক, সাধারণ মানুষ বলেছে, নজরুল ইসলাম আমাদের একান্ত আপনজন। এরা বলেছে, পুঁথি সাহিত্যই আসল সাহিত্য, সাধারণ পাঠক বুঝে নিয়েছে পুঁথি সাহিত্যের পক্ষে ওই প্রচারে ফাঁকি আছে। মোটকথা, এদের কাজ সম্পূর্ণ বিপরীত ফল উৎপাদন করেছে। তার কারণ এই যে, সাধারণ মানুষ জানত এরা তাদের স্বার্থের শত্রু, এরা তাদের বন্ধু নন, এদের উদ্দেশ্য পশ্চিমাদের শোষণব্যবস্থাটাকে কায়েমি করে রাখা।
এভাবে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন যেসব বুদ্ধিজীবী, তারাও নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, পরোক্ষে জনতার উপকারই করেছেন। জনতার দৃষ্টি খুলে দিতে তারাও সাহায্য করেছেন, এ করে জনতার আন্দোলনকে তারাও এগিয়ে দিয়েছেন।
বুদ্ধিজীবী সমাজের যে অংশ সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছিলেন, তারা বিবেকবান ছিলেন সত্য, কিন্তু তারাও আসলে নিজেদের স্বার্থেই কাজ করেছেন, তবে তফাত এই যে, তাদের স্বার্থকে তারা জনসাধারণের স্বার্থ থেকে ভিন্ন করে দেখেননি। এবং উভয়ের স্বার্থ যেহেতু ছিল এক ও অভিন্ন, তাই তাদের কাজের ফলে জনসাধারণের আন্দোলনের উপকার হয়েছে।
পাকিস্তান আন্দোলনের পেছনে কোনো দার্শনিক প্রস্তুতি ছিল না, যদিও পরবর্তীকালে প্রচার করা হয়েছিল, বিশিষ্ট জীবনদর্শনের প্রয়োজনেই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের আন্দোলনও কোনো গ্রন্থপাঠ থেকে শুরু হয়নি; কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা এ আন্দোলনে ছিলেন, এ আন্দোলনে তারা সরাসরি নেতৃত্ব দেননি, আন্দোলন যখন এগিয়ে গেছে, তখন তার গতির সঙ্গে সমতা রক্ষা করতেও হয়তো তারা পারেননি, পিছিয়ে পড়েছেন, তবু তারা সঙ্গেই ছিলেন, তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ভূমিকাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সভা করে গুলিবর্ষণের নিন্দা করেছেন, ফলে তাদের ভেতর থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। উনসত্তরের এবং একাত্তরের আন্দোলনের সময় শিক্ষকরা রাজপথে শোভাযাত্রা করেছেন।
এসব ঘটনা ছোট ঘটনা; কিন্তু এগুলোর তাৎপর্য আছে। তাৎপর্য এই যে, বোঝা গেছে বিক্ষোভ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে, তারচেয়ে বড় কথা, বোঝা গেছে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মানুষ এক হয়ে গেছে। সেই একতার দরুনই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
জনতার সঙ্গে চলা বুদ্ধিজীবী সমাজ জনতার অগ্রবর্তী অংশ হিসাবেই কাজ করেছে। পাকিস্তানের ব্যর্থতার লক্ষণ প্রথম ধরা পড়েছে তাদের কাছেই, পরে তারাই প্রমাণ পেয়েছেন সেই ব্যর্থতার। তারাই বুঝেছেন ভাষার ওপর আক্রমণের অর্থ কী, অর্থনীতির গতি কোন দিকে। সেই জ্ঞানকে তারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বাকি কাজটা সাধারণ মানুষ নিজেরাই করেছে। বাংলাদেশকে তারা স্বাধীন করে নিয়েছে নিজের হাতে।
লেখক :সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়