১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় জামায়াত

0
16

আইন, বিচার, সংসদ, নির্বাচনব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের সংস্কারে অর্ন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ১০ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছে জামায়াতে ইসল্লামী। প্রস্তাবে বল্লা হয়েছে-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, একই ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারা, সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত, ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা, সংসদের প্রধান বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করতে হবে। দলটি প্রস্তাবে আরও বলেছে, চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আগামী ২ বছরের জন্য ৩৫ বছর ও পরবর্তী বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করতে হবে, বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সরকারি চাকরিতে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও দলীয় বিবেচনায় চাকরি পেয়েছে তাদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে। বিচার বহির্ভূত সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। বুধবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসল্লামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।
এ সময় জামায়াতে ইসল্লামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মূলত তাদের সংস্কার প্রস্তাব ৪১ দফা, সেটা বিস্তারিত। এখন তারা সংক্ষেপে ১০ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। এই মুহূর্তে অর্ন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যেগুলো প্রাধান্য দেওয়া দরকার, সেগুলো দিয়েছেন। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে বাকিগুলো দেখবে।
এ প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন, ‘অর্ন্তর্বর্তী সরকার সবকটি সংস্কার করে দিলে নির্বাচিত সরকার এসে কী করবে। আমরা নির্বাচিত সরকারকেও পরীক্ষা করতে চাই। যখন আমরা বিরোধী দলে থাকি, আমাদের কণ্ঠ-আওয়াজ হয় এক রকমের, আর সরকারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে যাই। তাই আমিসহ আমাদের সবাইকে পরীক্ষা করতে চাই। আমরা আগের জায়গাতেই আছি, নাকি এত বড় একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদেরও মানসিকতার কিছু পরিবর্তন হয়েছে, সেটা আমরা একটু দেখতে চাই।’
তিনি বলেন, দেড় সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অর্ন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান প্রধান সেক্টর সংস্কারের জন্য ১০ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন নায়েব আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। আইন ও বিচার সংস্কারের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো-বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের কার্যকর ব্যবস্থা, আইন মন্ত্রণালয় থেকে আল্লাদা করে সুপ্রিমকোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ ও সব কালো আইন বাতিল করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা, নিন্ম আদালতের যথাযথ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন, সব ফৌজদারি মামল্লা তদন্তের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
সংসদবিষয়ক সংস্কারে দলটির প্রস্তাবের উল্লেখযোগ্য হলো-সংসদের প্রধান বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করা, সংসদীয় বিরোধীদলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের উল্লেখযোগ্য হলো-জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত, ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল, কোনো সরকারি চাকরিজীবী তাদের চাকরি ছাড়ার কমপক্ষে ৩ বছরের মধ্যে কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ২০০৮ সালে প্রবর্তিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা বাতিল, নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠন ও সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খল্লা সংস্কারের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো-পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের ক্ষেত্রে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তন এবং পুলিশের জন্য একটি পলিসি গাইডল্লাইন তৈরি, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশের সুযোগ রাখা যাবে না তথা সর্বপ্রকার দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রভাব বা হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, পুলিশের মধ্যে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাতিল, রিমান্ড চল্লাকালে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আসামিপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি এবং মহিল্লা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের অভিভাবকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
র‌্যাববিষয়ক সংস্কারে বল্লা হয়েছে-গত সাড়ে ১৫ বছর যারা র‌্যাবে কাজ করেছেন তাদেরকে নিজ নিজ বাহিনীতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদেরকে পুনরায় র‌্যাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। জনপ্রশাসন সংস্কারে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো-সরকারি চাকরিতে আবেদন বিনামূল্যে করা, চাকরির আবেদনে সব ক্ষেত্রে বয়সসীমার বৈষম্য নিরসন করা, সব সরকারি দপ্তরে দুর্নীতি নিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করা যাতে করে কেউ দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়-এজন্য প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা, চাকরিতে বিরাজমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা।
দুর্নীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো-দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া, বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার পদক্ষেপ নেওয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনসংস্কার, জনবল ও পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে বল্লা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার বিধান সংযুক্ত এবং একই ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারার বিধান করা। শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্কারে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো-ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চমাধ্যমিক হিসাবে বলবৎ রাখা, অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে পূর্বের পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা, পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে।
পররাষ্ট্রবিষয়ক সংস্কারে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো-জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চীন, নেপাল, ভারত ও বাংল্লাদেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিবণ্টন চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা, অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বিগত সরকারের আমলে সম্পাদিত সব চুক্তি রিভিউ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি রিভিউ কমিশন গঠন করতে হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয় সংস্কারে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো-ইসল্লামিক ফাউন্ডেশন বাংল্লাদেশকে রাষ্ট্রের কল্যাণে অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোল্লা এবং হজ ব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা।
কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দের সঞ্চালনায় আরও উপস্থিত ছিলেন-নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও মাওল্লানা আনম শামসুল ইসল্লাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওল্লানা এটিএম মাছুম, মাওল্লানা রফিকুল ইসল্লাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও মাওল্লানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন ও মোবারক হোসাইন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসল্লাম বুলবুল, উত্তরের আমির জনাব সেলিম উদ্দিন, ইসল্লামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসল্লাম প্রমুখ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here