ভারতের মহারাষ্ট্রের হাজার হাজার কৃষক পায়ে হেঁটে রাজধানী মুম্বাইয়ের দিকে পদযাত্রা শুরু করেছে। কৃষকরা দাবি করছে যে পেঁয়াজ চাষ করে তাদের বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে এ বছর, সরকার অনুদান দিয়ে সেই ক্ষতি পূরণ করুক।
সোমবার নাসিক শহর থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি বুধবার সন্ধ্যায় পৌঁছেছে থানে জেলার কাসওয়া ঘাটে। ইতোমধ্যেই মিছিলটিতে প্রায় ২০ হাজার কৃষক যোগ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন নাসিকে বিবিসির সহযোগী সংবাদদাতা প্রভিন ঠাকরে।
তিনি আরো জানিয়েছেন, মিছিল যত মুম্বাইয়ের দিকে আগাবে, ততই বহরে কৃষকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কৃষকদের এই মিছিলটি সংগঠিত করছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-মার্ক্সবাদী (সিপিআইএম) দলের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কৃষক সভা। ২০১৮ সালেও এমনই একটি মিছিল মুম্বাইতে গিয়েছিল।
কী দাবিতে কৃষকদের মিছিল?
মিছিলে হাঁটার পথেই সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সভাপতি উমেশ দেশমুখ বলছিলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের দাবিগুলো খুব স্পষ্ট। এ বছর পেঁয়াজ চাষ করে উত্তর মহারাষ্ট্রের হাজার হাজার কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কুইন্টাল (একশো কেজি) প্রতি মাত্র সাত শ’ টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে, যা উৎপাদন খরচের অর্ধেক। সরকার সর্বনিম্ন সংগ্রহ মূল্য দুই হাজার টাকা কুইন্টাল প্রতি নির্দিষ্ট করুক, যার মধ্যে অনুদান হিসেবে দেয়া হোক পাচ শ’ থেকে ছয় শ’ টাকা করে।’
ফসলের ক্ষতি হলে বীমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করা, বিদ্যুতের বিল আর কৃষি ঋণ মওকুফ করাসহ আরো একগুচ্ছ দাবি নিয়ে কৃষকরা এখন যাচ্ছে মুম্বাইয়ের দিকে।
ওই মিছিলে যে শুধু পেঁয়াজ-চাষিরা যোগ দিয়েছে তা নয়। সংগঠকরা বলছেন, দুধ উৎপাদনকারী, সয়াবিন, তুলা আর ডাল-চাষিরাও যে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছে, তারও সমাধান চান তারা।
পেঁয়াজ চাষ করে ক্ষতির মুখে
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এ বছর কৃষকরা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পাঞ্জাব থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের আলু-চাষি, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজ-চাষি হোন ও ছত্তিশগড়ের সবজি-চাষি- প্রায় সব জায়গাতেই ক্ষতির পরিমাণ কমাতে তারা ক্ষেতেই ফসল নষ্ট করে দিচ্ছে।
মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ-চাষি কৃষ্ণ ডোংরে তার ক্ষেতের ১৫ হাজার কেজি পেঁয়াজ পুড়িয়ে ফেলেছেন। ট্রাক্টর চালিয়ে তিন একর জমির পেঁয়াজ নষ্ট করে দিয়েছেন সেখানকারই আরেক পেঁয়াজ-চাষি রাজেন্দ্র বোঢ়গুঢ়ে।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বোঢ়গুঢ়ে বলেছিলেন, ‘তিন একর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম এ মৌসুমে। পেঁয়াজ মণ্ডিতে আড়ৎদারের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া পর্যন্ত এক লাখ ১০ হাজার টাকা মতো খরচ হয় প্রতি একরের ফসলে। এক একরে ১৫০ কুইন্টাল তো হয়, ভালো ফলন হলে ১৭০ থেকে ১৮০ কুইন্টালও হয়। সেই হিসেব যদি করেন, তাহলে এক একরের ফসল থেকে গড়ে আমি দাম পাচ্ছি ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। যা আমার খরচের অর্ধেক। তো সেই ফসল আড়তে পৌঁছে দেয়ার জন্য আরো বাড়তি খরচ করে লোকসানের বোঝা বাড়াবো কি?’
এক সপ্তাহ আগেও তারা প্রতি কেজি পেঁয়াজের জন্য দুই/তিন টাকা করে পাচ্ছিলেন। গত সপ্তাহের শেষ দিকে অবশ্য দাম সামান্য বেড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবে ক্ষতির মুখে আলু-চাষিরা
মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে বহু দূরে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর, যে অঞ্চলটি আলু ফলনের জন্য পরিচিত। নাসিকের পেঁয়াজ-চাষিরা যেমন অতিরিক্ত ফলনের জন্য ক্ষতির মুখে পড়েছে, তেমন সিঙ্গুর এলাকায় আবার এ বছর বিঘা প্রতি আলুর ফলন কম হয়েছে।
সেখানকার এক কৃষক প্রহ্লাদ মণ্ডলের কথায়, ‘চাষের উৎপাদন খরচ গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেকটা বেড়ে গেছে। যে সার আমরা গত বছর কিনেছি এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়, এ বছর সেই সার কিনতে হয়েছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায়। কৃষিশ্রমিকদের মজুরি ৩০০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় পানির খরচ বেড়েছে ৫০ টাকা করে। আমার এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তার ওপরে আমার মতো এলাকার অনেকের জমিতেই ফলন প্রায় অর্ধেক হয়েছে।’
প্রহ্লাদ মণ্ডল জানান, ‘সরকার থেকে যে সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে, তা হলো ৬৫০ টাকা প্রতি ১০০ কেজি। আমি ০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে পাচ্ছি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা।’
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের আলু-চাষিরাও রাস্তায় আলু ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
আবার পাঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশের মতো অনেক রাজ্যে আলুর প্রচুর ফলন হয়েছে এ বছর। তাই সেখানে আলুর দাম কমে গেছে।
দারুণ ফলন এ বছর, তাই দাম মুখ থুবড়ে পড়েছে
ভারতের কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে ‘নিউজপোটলি’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল চালান সাংবাদিক অরভিন্দ শুক্লা। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘গত বছর নাসিকের পেঁয়াজ-চাষিরা বিক্রি করেছেন ২০ টাকা কেজি দরে, যেটা ১০০ টাকা করে কিনে খেয়েছি আমরা। কৃষকদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, এ বছর যে ফসলের দাম বেশি উঠল, পরের বছর তারা সেটা আরো বেশি করে চাষ করে। এ বছর ঠিক সেটাই হয়েছে। গত বছর বেশি দাম পেয়েছে দেখে এ বছর আরো বেশি করে চাষ করেছে, আর তাদের সাহায্য করেছে আবহাওয়া। তাই বেশিরভাগ জায়গায় আলু বা পেঁয়াজের ফলন অত্যধিক বেশি হয়েছে। আর মুখ থুবড়ে পড়েছে দাম।’
তিনি ইসরাইলের উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, ‘সেখানে চাহিদা অনুযায়ী চাষ করা হয়। যাতে অতিরিক্ত ফলনের কারণে দাম না কমে যায়, আবার খাদ্য ভাণ্ডারেও টান না পড়ে। আমাদের দেশে তো ওই ব্যবস্থাপনা নেই। দেশের জন্য কী পরিমাণ সবজি লাগবে, বিদেশে কতটা রফতানি হবে, সে সব তথ্য মিলিয়ে কৃষকদের নির্দেশ দেয়া যেতে পারে যে এই পরিমাণের বেশি চাষ করা যাবে না। আর সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা তো নেই-ই। নাসিকে দেখে এলাম আলুর দাম কেজি প্রতি ২৫ টাকা আর আমি উত্তরপ্রদেশের যে শহরে থাকি, সেই বারাবাঙ্কিতে আলু চার টাকা। সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা থাকলে কী এই অবস্থা হয়?’
রাজনৈতিক দল বা সরকারের মাথ্যাব্যাথা নেই
মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা বলছে, আলু বা পেঁয়াজের দাম যখন বাজারে খুব বেড়ে যায়, তখন সরকার তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিতে নামে, যেন সাধারণ মানুষের ওপরে চাপ বেশি না পড়ে।
কিন্তু যখন কৃষকরা অত্যধিক কম দামে সবজি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়, তখন রাজনৈতিক দল বা সরকারের মাথাব্যাথা হয় না, সেগুলো নিয়ে জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো টকশো করে না।
কৃষি বিশেষজ্ঞ দেবেন্দ্র শর্মা বিবিসিকে বলছিলেন, ‘যখন শহরাঞ্চলের মানুষদের বেশি দামে সবজি কিনতে হয়, তখন দেশের সংবাদমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ে, সরকার চাপে পড়ে। কিন্তু যখন কৃষকদের সামান্য দামে ফসল বিক্রি করে দিতে হয়, তখন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না।’
পেঁয়াজের দাম নিয়ে সরকার গত সপ্তাহ থেকেই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। তারা জাতীয় কৃষি সমবায় ন্যাফেডের মাধ্যমে পেঁয়াজ কিনতে শুরু করেছে, যার ফলে পেঁয়াজের দাম কিছুটা হলেও বেড়েছে। কিন্তু তা চাষিদের ক্ষতি এখনো পূরণ করার মতো অবস্থায় আসেনি।
সূত্র : বিবিসি