বিতর্কের মধ্যেই দিল্লিতে ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন হলো। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে ‘বাদ দিয়ে’ই রোববার নতুন পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন করলেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রীর পরনে ছিল সাদা কুর্তা, সোনালি জ্যাকেট এবং তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উত্তরীয়। রোববার নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধনের আগে ঐতিহাসিক রাজদণ্ড ‘সেঙ্গোল’-এর সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথমবার পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশের আগেও সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছিলেন তিনি। পরে অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাসের সময়েও মোদিকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে দেখা গিয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাতে সংসদ ভবন উদ্বোধনের এই বহর দেখে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। এই অনুষ্ঠানকে মোদির ‘রাজ্যাভিষেক’ বলে কটাক্ষ করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। নতুন সংসদ ভবনের সাথে কফিনের তুলনা করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে লালুপ্রসাদ যাদবের দল আরজেডি। পাল্টা জবাব দিয়েছে বিজেপিও।
সংসদের নতুন ভবন উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না করা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই বিতর্ক চলছিল জাতীয় স্তরে। মোদির হাতে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের বিরোধিতা করে এই অনুষ্ঠান বয়কট করেছে ২০টি বিরোধী দল। গত মঙ্গলবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র হাতে পেতেই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল প্রথম বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর একে একে কংগ্রেস আম আদমি পার্টি, ডিএমকে, আরজেডি, সমাজবাদী পার্টি অনুষ্ঠান বয়কটের ডাক দেয়। তার মধ্যেই ‘সেঙ্গোল’ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই রাজদণ্ডকে নতুন সংসদ ভবনে স্থাপন করার মধ্যে মোদীর রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা দেখছেন অনেকে। প্রথমত, বার বার নেহরুর কথা তুলে এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির রাতের বর্ণনা দিয়ে কংগ্রেসকে চাপে ফেলার কৌশল। দ্বিতীয়ত, তামিলনাড়ুর ঐতিহ্য এই রাজদণ্ডকে অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে এনে সেই রাজ্যের শাসকদল ডিএমকে-কে কোণঠাসা করার চেষ্টা।
উল্লেখ্য, গত বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংবাদ সম্মেলনে তামিলনাড়ুর ঐতিহ্য সংবলিত এই সেঙ্গোলের ইতিহাস বর্ণনা করেন। জানান, ব্রিটিশদের কাছ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক হিসাবে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই সেঙ্গোল গ্রহণ করেছিলেন। পাল্টা কংগ্রেসের রাজ্যসভা এমপি জয়রাম রমেশ বলেন, সেঙ্গোলের ইতিহাস নিয়ে কেন্দ্র যা বলছে, চেন্নাইয়ের এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্পনাপ্রসূত। তার মতে, চেন্নাইয়ে তৈরি এই রাজদণ্ডটি ১৯৪৭ সালের অগস্টে জওহরলাল নেহরুকে উপহার দেয়া হয়েছিল। তার কথায়, ‘কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন, রাজাজি এবং নেহরু এই রাজদণ্ডকে ক্ষমতা প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করেছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই।’
নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন
রোববার সকালেই নয়া সংসদভবন চত্বরে পৌঁছে যান মোদি। সেখানে তার সাথে ছিলেন লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা। পাশাপাশি বসে পুজোয় অংশ নেন দু’জনে। পুজায় সংকল্প করেন মোদি। আরতিও করেন। এর পর সামনে রাখা ‘সেঙ্গোল’ দেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে তার হাতে ‘সেঙ্গোল’ তুলে নাম তামিল অধিনাম পুরোহিতেরা। এর পর পুরোহিতদের দ্বারা পরিবৃত হয়েই নয়া পার্লামেন্ট ভবনের অন্দরে প্রবেশ করেন মোদি। নতুন সংসদ ভবনে লোকসভার স্পিকারের আসনের কাছেই রাখা থাকবে ‘সেঙ্গল’। সেই মতো সেখানেই সোনার রাজদণ্ডটি স্থাপন করেন মোদী। তার পর পুরোহিতদের প্রণাম সেরে বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সম্মান জানানো হয় সংসদ ভবনের নির্মাণে যুক্ত থাকা কর্মীদের। গলায় পরানো হয় উত্তরীয়। এর পর বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে শুরু হয় বিশেষ সর্বধর্ম প্রার্থনাসভা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় দুপুর ১২টা নাগাদ। জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয় সেই পর্ব। অনুষ্ঠান শেষে ৭৫ রুপির মুদ্রা ও ডাকটিকিট প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে কী বললেন প্রধানমন্ত্রী
নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ ভারতের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। নতুন সংসদ ভবন নতুন ভারতের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এটি গণতন্ত্রের মন্দির। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই সোনালি মুহূর্তের জন্য আমি সকল দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাই। আগামী দিনে এই নতুন সংসদ স্বনির্ভর ভারতের উত্থানের সাক্ষী হয়ে উঠবে। ভারত যখন এগিয়ে যায়, তখন বিশ্ব এগিয়ে যায়। সংসদের এই নতুন ভবন ভারতের উন্নয়নের সাথে সাথে বিশ্বের উন্নয়নের আহ্বান জানাবে। ভারত গণতন্ত্রের জননী। পবিত্র সেঙ্গোল আজ সংসদে স্থাপিত হয়েছে। চোল রাজবংশের সেঙ্গোল ন্যায়বিচার, ন্যায়পরায়ণতা এবং সুশাসনের প্রতীক। যখনই এই সংসদ ভবনে কার্যক্রম শুরু হবে, সেঙ্গোল আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করবে।’ বিরোধীদের প্রসঙ্গে মোদি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, যে জনপ্রতিনিধিরা নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে এই সংসদে বসবেন, তাঁরা গণতন্ত্রকে নতুন দিক নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।’
পুরনো সংসদ ভবনের পাশেই নতুন ভবন তৈরি করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৬৪ হাজার বর্গ মিটার জায়গার উপর গড়ে উঠেছে ত্রিভুজাকৃতি চারতলা ভবনটি। মোট তিনটি দরজা রয়েছে। এগুলোর নাম— জ্ঞানদ্বার, শক্তিদ্বার ও কর্মদ্বার। নতুন ভবনে লোকসভা, রাজ্যসভা, সেন্ট্রাল লাউঞ্জ, সংসদীয় কর্তৃপক্ষের কার্যালয়, কনস্টিটিউশন হল, গ্রন্থাগার, ডাইনিং রুম এবং থাকছে পর্যাপ্ত গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূরের আদলে তৈরি হয়েছে লোকসভা। রাজ্যসভা তৈরি হয়েছে জাতীয় ফুল পদ্মের আদলে। দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট ৩৫ হাজার বর্গফুট মেঝেতে যে কার্পেট বিছানো হয়েছে, তা তৈরি করেছে দেশের ১০০ বছরের পুরনো কার্পেট প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘ওবিতি কার্পেট’, যার বর্তমান কর্ণধার বঙ্গসন্তান রুদ্র চট্টোপাধ্যায়। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই কার্পেট তৈরিতে কাজে লাগানো হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের ভাদোহি এবং মির্জাপুর জেলার ৯০০ শিল্পীকে। দু’টি কক্ষের জন্য ১৫০টি করে কার্পেট বোনা হয়েছে। তার পর সেই কার্পেটগুলোকে জুড়ে একটি পূর্ণ কার্পেট বানানো হয়েছে।
রুদ্র বলেন, ‘রাজ্যসভার জন্য যে কার্পেট বানানো হয়েছে, তাতে লাল আভা দেয়া হয়েছে। আর ময়ূরপুচ্ছের রঙের বিষয়টি মাথায় রেখেই লোকসভার কার্পেটের রং করা হয়েছে সবুজ।’ এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিখ্যাত উপকরণ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন সংসদ ভবন। অন্দরসজ্জাতেও রয়েছে নানা চমক। তার মধ্যে রয়েছে নাগপুরের সেগুনকাঠ থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর থেকে আনা কার্পেট! এ ছাড়াও রাজস্থানের সরমথুরা থেকে লাল এবং সাদা বেলেপাথর এনে তৈরি হয়েছে সংসদ ভবনের একাংশ। রাজ্যসভা এবং লোকসভার ‘ফলস সিলিং’ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে ইস্পাতের কাঠামো, যা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দমন এবং দিউ থেকে আনানো।
কফিন বিতর্ক
নতুন সংসদ ভবনকে কফিনের সাথে তুলনা করেছে আরজেডি। রোববার টুইটারে একটি ছবি পোস্ট করা হয় লালুর দলের তরফে। দেখা যায়, ছবিটির বাঁ দিকে একটি কফিন, ডান দিকে নতুন সংসদ ভবন। বিবরণীতে লেখা, ‘এটা কী?’ দলের নেতা শক্তিসিংহ যাদব বলেন, ‘গণতন্ত্রকে কবর দেওয়া হচ্ছে, সেটা বোঝাতেই টুইটে কফিনের ছবি দেওয়া হয়েছে। দেশ এই সংসদ ভবনকে মেনে নেবে না। সংসদ হলো গণতন্ত্রের মন্দির এবং আলোচনার পীঠস্থান।’
পাল্টা জবাব দিয়েছে বিজেপিও। সুশীল মোদি পাল্টা টুইট করে হুঁশিয়ারি দেন, ‘যারা নতুন সংসদ ভবনকে কফিনের সাথে তুলনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার মামলা দায়ের করা হবে।’ কফিন বিতর্কে বিজেপি মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘২০২৪ সালে দেশের মানুষ আপনাদের সেই কফিনেই কবর দেবে।’
অনুষ্ঠান নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষ
নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের অনুষ্ঠানকে মোদির ‘রাজ্যাভিষেক’ বলে কটাক্ষ করেছেন রাহুল। সংসদ ভবনের উদ্বোধন নিয়ে একটি টুইটে কংগ্রেস নেতা লিখেছেন, ‘সংসদ আসলে দেশের মানুষের গলার স্বর। প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনের উদ্বোধনকে রাজ্যাভিষেক ভেবেছেন!’ সংসদ ভবনের উদ্বোধনে পুজো, যজ্ঞ এবং প্রার্থনার আয়োজন দেখে কটাক্ষ করেছেন এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ার। তিনি বলেন, ‘সকালের অনুষ্ঠান আমি দেখেছি। আমি যে ওখানে যাইনি, তাতে আমি খুশি। ওখানে যা যা হয়েছে, দেখে আমি চিন্তিত। আমরা কি দেশটাকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছি?’ পাওয়ারেরও প্রশ্ন, ‘এই অনুষ্ঠান কি শুধুমাত্র কয়েক জন মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল?’ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পাল্টানোর রাজনীতিতে বোধহয় বেশি বিশ্বাস করেন। সংসদ ভবন না পাল্টে প্রধানমন্ত্রী নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে দেশের উপকার হতো। রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না জানানোই প্রমাণ করে, প্রধানমন্ত্রী আদিবাসী ও নারীদের সম্মান করেন না।’
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা