প্রায় এক দশক পরে ভারতের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন। এস জয়শঙ্কর সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) বৈঠকে যোগ দেবেন চলতি মাসের মাঝামাঝি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এ খবর নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে, ২০১৫ সালে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ‘হার্ট অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দিতে ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন। তার কয়েক দিন পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আচমকাই এক সফরে হাজির হয়েছিলেন লাহোরে।
এত দিন পরে আবারো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানে যাচ্ছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে জয়শঙ্করের এই সফর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি সাধনের প্রচেষ্টা কিনা।
জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘এই সফর এসসিও বৈঠকের জন্য, এর থেকে বেশি কিছু ভাবা উচিত না।’
বিশ্লেষকদের একাংশও মনে করছেন, ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সফর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু এসসিওর দিক থেকে বিচার করলে আবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই পাকিস্তান সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান সফরে কী বার্তা দেবে ভারত?
নয়াদিল্লিতে অবজার্ভার রিসার্চ ফাউণ্ডেশনের বিদেশনীতি বিভাগের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ বলেন, ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা পুরোপুরি মেটেনি। সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসলে কারা রয়েছেন, সেটাও স্পষ্ট নয়। তাই পাকিস্তানের প্রশাসনের সাথে এখনই সরাসরি আলোচনা চালানোর কোনো কারণ ভারতের দিক থেকে নেই। তাই মনে হয় না যে এই সফরের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে।’
তবে তিনি এটাও বলছেন যে নয়াদিল্লি এটাও চায় না যে ভারতের ‘মিত্র দেশ’গুলোর মধ্যে এরকম একটা ধারণা সৃষ্টি হোক যে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রভাবে এসসিওর কাজকর্মে কোনো বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
তার কথায়, ‘ভারত এটা চাইবে না যে এসসিওর অন্য সদস্য দেশগুলোর এরকম একটা ধারণা হোক যে ভারত তার বিদেশনীতিতে এসসিওর গুরুত্ব কম করে দিচ্ছে। দেখুন, যদি প্রধানমন্ত্রী নিজে পাকিস্তান যেতেন, সেটার একটা আলাদা বার্তা দেয়া হতো, তার একটা আলাদা গুরুত্ব বোঝা যেত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে যাচ্ছেন না, তার জায়গায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যাচ্ছেন। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে শীর্ষ নেতৃত্বের পর্যায়ে এখনই পাকিস্তানের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় জড়াতে রাজি নয় ভারত।’
তার বিশ্লেষণ, ‘আবার এস জয়শঙ্করের সফরের মাধ্যমে এই বার্তাটাও দেয়া হচ্ছে যে এসসিওর মতো বহু-দেশীয় মঞ্চে নিজের দায়িত্ব পালন করতেও প্রস্তুত ভারত।’
ওয়াশিংটন ডিসির উইলসন থিঙ্কট্যাঙ্কে দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানও মনে করেন যে জয়শঙ্করের এই সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এসসিওর জন্য।
তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যাণ্ডেলে (সাবেক টুইটার) লেখেন, এই সফরের সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি সাধনের সদিচ্ছার থেকেও সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) প্রতি ভারতের অঙ্গীকার প্রমাণ করে।
তবে তিনি আরো লেখেন, জয়শঙ্করের পাকিস্তান সফর যদিও ‘দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির থেকেও বহুপক্ষীয় কূটনীতিই বেশি, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর গুরুত্বকে উপেক্ষা করা উচিত নয়।’
তার ব্যাখ্যা, দীর্ঘদিন পরে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পাকিস্তানে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লেখেন, ‘২০১৬ সালের পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় ক্যাবিনেট মন্ত্রী পাকিস্তানে যাচ্ছেন।’
সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন রাজনাথ সিং।
অনেক দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন সাবেক কূটনীতিক রাজিব ডোগরা। তিনি রাজনাথ সিংয়ের সাথে সেই পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন।
ডোগরা বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর ভারতের দিক থেকে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, কিন্তু ‘পাকিস্তানের আচরণ সম্পর্কে কিছু বলা যায় না।’
রাজনাথ সিংয়ের ওই পাকিস্তান সফরের কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘সেই সময়ে পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান রাজনাথের সাথে বেশ খারাপ আচরণ করেছিলেন।’
পাকিস্তানের আচরণের প্রসঙ্গে ডোগরা আরো উল্লেখ করেন, পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টোর গত বছরের ভারত সফরের কথাও।
তিনি বলেন, ‘বিলাওয়াল ভুট্টো যখন এসেছিলেন, তখন তিনি যে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত ছিল না, তাই আলোচনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়।’
জয়শঙ্করের মনোভাব কেমন হতে পারে?
গত বছর মে মাসে এসসিও বৈঠকে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই মনে করা হয়েছিল যে বিলাওয়াল ভুট্টোর সফর দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি করতে পারে।
কিন্তু বৈঠকের ঠিক এক দিন পরই দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কড়া মন্তব্য প্রকাশ পায়।
এখন যখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পাকিস্তানে যাচ্ছেন, তখন তিনি কেমন মনোভাব প্রকাশ করবেন?
এ বিষয়ে অধ্যাপক পন্থ বলেন, ‘তিনি এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তানে যাচ্ছেন, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে তো নয়। সেখানে ভারতের গঠনমূলক ভূমিকা পালনের ওপরে জোর দেবেন জয়শঙ্কর। তাই আমার মনে হয় না যে তিনি সেখানে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপক্ষীয় মতপার্থক্যগুলো তুলে ধরবেন।’
তিনি আলো বলেন, ‘পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলে এস জয়শঙ্করের আগ্রাসী মনোভাব প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু আপনি যদি পাকিস্তান বাদে অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর কথা বলেন, তিনি সেক্ষেত্রে কিন্তু বিচক্ষণ কূটনীতিক। এর সব থেকে বড় উদাহরণ হলো মালদ্বীপ। একটা সময় যখন মালদ্বীপে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা হচ্ছিল এবং ব্যাপক টানাপোড়েন চলছিল, তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা নেতারা কোনো মন্তব্য করেননি। এর ফলে কয়েক মাস পর ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।’
সাবেক কূটনীতিক রাজিব ডোগরা অবশ্য মনে করেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্পর্কের উন্নতি করতে সফল হবেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অভিজ্ঞ কূটনীতিক ও নেতা। তিনি যখন পাকিস্তান সফরে যাবেন তখন তার মনোভাব এমনটাই হবে যে দু’দেশের সম্পর্কের ওপর জমে থাকা বরফ ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু বৈঠকটি এসসিওর, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।’
বিশ্বের অন্যান্য দেশ এই সফরকে কী চোখে দেখবে?
বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বাস করেন এসসিও-ভুক্ত দেশগুলোতে। বিশ্বের জিডিপির ২০ শতাংশও এসসিও গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর। আবার বিশ্বের জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশও এই দেশগুলোতেই মজুত রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে এসসিও-ভুক্ত দেশগুলো কী করছে, তার দিকে নজর রাখে গোটা বিশ্ব। এই প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাকিস্তান সফরকে বিশ্বের অন্যান্য দেশ কী চোখে দেখতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক পন্থ বলেন, চীন বা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক যাই হোক না কেন, এসসিওতে নিজেদের ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরাই ভারতের লক্ষ্য। এই সফরের মাধ্যমে ভারতের একটা ভূমিকা স্পষ্ট যে এসসিওতে তারা পুরোপুরি অংশগ্রহণ করছে আর একটা ইতিবাচক অ্যাজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ভারত বিশ্বকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, ভারত নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার নিজের শর্তে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের দিকে নজর দেবে।
‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি?
সাবেক কূটনীতিক কেপি ফ্যাবিয়ান এস জয়শঙ্করের এই সফরকে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতিরই একটা অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।
বার্তাসংস্থা এএনআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই মনে আছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মালদ্বীপে তিন দিন কাটিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করলেন। এটা ভালো লক্ষণ যে তিনি পাকিস্তানে যাচ্ছেন।’
তবে এই নীতি যে ‘পুনরুজ্জীবিত’ হচ্ছে, সে বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ।
তিনি বলেন, ভারত তো সবসময়েই ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’নীতি নিয়ে চলেছে। তার কথায়, ‘প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আপনি দূরে থাকবেন কিভাবে? প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারত কখনই নিজের দায়িত্ব এড়ায়নি, কিন্তু পাকিস্তান কখনই ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’নীতির অংশ ছিল না।
ভারত-পাকিস্তানের জন্য এসসিও কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
চীন, রাশিয়া এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এমন চারটি মধ্য এশিয়ার দেশ- কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান একসাথে ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এসসিও গঠন করে।
তবে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে সাংহাইয়ে একটি বৈঠকে চীন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তান সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা মোকাবেলায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছিল।
ভারত ও পাকিস্তান ২০১৭ সালে এসসিওর পূর্ণ সদস্য হিসেবে যোগ দেয় এবং ২০২৩ সালে ইরান এর সদস্য হয়। এখন নয়টি দেশ এসসিওর সদস্য।
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে আফগানিস্তান, বেলারুশ ও মঙ্গোলিয়া পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়েছে।
যে দু’টি দেশ এসসিওর নেতৃত্ব দেয়, সেই রাশিয়া আর চীন- দু’দেশের সাথে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক আছে।
পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর কারণেও এসসিও পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অঞ্চলে বাণিজ্য, সংযোগ এবং শক্তি খাতগুলোতে সহযোগিতা বৃদ্ধির আশা করে পাকিস্তান।
ভারতের জন্য এটি আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মঞ্চ, যেটি একদিকে প্রতিবেশীদের ও অন্য দিকে মধ্য এশিয়ার সাথে তাদের সংযোগ তৈরি করেছে।
অধ্যাপক পন্থ বলেন, ‘যেহেতু মধ্য এশিয়ার সাথে ভারতের সংযোগ সীমিত, তাই এসসিওর মাধ্যমে ওই অঞ্চলে ভারতের উপস্থিতি ও ভূমিকা বজায় রাখা ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক পন্থ বলেন, ‘তাই এই সফরকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে বহুপক্ষীয় মঞ্চে ভারতের অংশগ্রহণ এবং কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত।’
সূত্র : বিবিসি