দখল ও লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। জুন প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আরও দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পাঁচ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে আগামীতে মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আরও বেড়ে যাবে। কিছু দুর্বল ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা তুলতে আরও বেগ পেতে হবে। ব্যাংক খাতের এ সংকট আরও দীর্ঘ সময় থাকবে। এখন কার্যত ১২টি ব্যাংক দেউলিয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। তারা আমানতকারীদের টাকা দিতে পারছে না। ১৫টি ব্যাংক অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। যার আটটিতেই (অর্ধেকের বেশি) লুটপাট হয়েছে।
রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ব্যাংক খাত নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ ওয়েইডেন যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। বক্তব্য দিয়েছেন ব্যাংকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। মূল প্রবন্ধের খসড়া গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম। বক্তৃতা দেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন ও ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন প্রমুখ।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাত ধ্বংস করে দিয়েছেন। আর তার সহযোগীরা আরও ধ্বংস করেছেন। এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে আরও অনেক সময় লাগবে। ব্যাংক খাতে সংস্কারের যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো ইতিবাচক। কিন্তু সংস্কার হলেও রাজনৈতিক সরকার এসে সংস্কারকে আর চলমান রাখে না। পাশাপাশি যেসব সংস্কার সম্পন্ন হয়, সেগুলোরও ধারাবাহিকতা বজায় রাখে না। ফলে ব্যাংক খাতের অবস্থা আগের পর্যায়ে চলে যায় বা আরও অবনতি ঘটে।
বক্তারা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত থেকে আওয়ামী লীগ সরকার একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত পেয়েছিল। কিন্তু তারা এর সুফল ধরে রাখতে পারেনি। বরং তারা সংস্কারগুলো আগের অবস্থায় নিয়ে যায়। যার ফলে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। লুটপাটে ব্যাংক খাত ধ্বংস হয়েছে।
সেমিনারে ব্যাংক খাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তারা আরও বলেন, লুটপাটের টাকা বেশির ভাগই পাচার হয়ে গেছে। যে কারণে সেগুলো আদায়ের সম্ভাবনা নেই। ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বেড়েছে। এ সংকট আরও থাকবে।
সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে দেশের প্রবৃদ্ধির জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। সে দেশে বিশেষ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ আসতে পারে। দুর্বল অবকাঠামোর কারণে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কম আসছে। বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে, তেমনি কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে। সংস্কারের বিষয়ে গভর্নর বলেন, ব্যাংক খাতে সংস্কার চলছে। এটি চালিয়ে যাবে সরকার। ধরে রাখার দায়িত্ব নতুন সরকারের। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে যেসব লুটপাট হয়েছে তাকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ খাতকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো চ্যালেঞ্জিং।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, একজন মাত্র ব্যক্তি যেমন একটি ব্যাংক ধ্বংস করে দিতে পারে। উলটোভাবে এক দুজন সৎ পরিচালকও একটি ব্যাংকের সফলতার জন্য যথেষ্ট। দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাগ্রস্ত ঋণ। এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। বিদেশি ব্যাংক বাদ দিয়ে স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে ৫০টি। এর মধ্যে কমবেশি ৪০টি ব্যাংকই মানসম্মত নয়। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫টি ব্যাংককে বলা হচ্ছে একেবারে জম্বি ব্যাংক (অতিমাত্রায় দুর্বল)। এসব ব্যাংকের অর্ধেকেই সরাসরি লুটপাট হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার কথা বলা হয়েছে। একটি পরিবার একটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার রাখতে পারবে। তবে পরিবারের সংজ্ঞায় বিভিন্ন ধরনের আত্মীয়স্বজনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবে দেশের ব্যাংক খাতে বড় লুটপাট হয়েছে বেনামি নামে, বৈধ শেয়ার মালিকানার কারণে নয়। বেনামিতে ব্যাংক লুটপাট বন্ধ করতে আইনি কাঠামো দরকার।