বিশেষ বিবেচনায় আর্থিক সংকটে পড়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় সচল করতে নতুন একটি বিশেষ ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নীতির আওতায় সর্বোচ্চ দুই বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। কোনো কারণে প্রয়োজন হলে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণে নীতি সহায়তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাছাই কমিটিতে আবেদন করা যাবে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হবে। এই নীতিমালার আওতায় খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে হবে।
সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেক ব্যবসায়ী পালিয়ে গেছেন। তাদের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত সরকারের আমলে জালিয়াতি করে নেওয়া ঋণও খেলাপি হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কারণেও ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতেও অনেকে সমস্যায় পড়েছেন। এছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতিতেও অনেক উদ্যোক্তা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এসব কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমানো ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন ঋণের জোগান দিয়ে সচল রাখার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ছাড় দিয়েছে। এই ছাড়ের যাতে কোনো ধরনের অপব্যবহার না হয় সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর তদারকির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সার্কুলারে বলা হয়, ৩০ জুন পর্যন্ত যেসব গ্রাহক খেলাপি হয়েছেন এই ছাড়ের আওতায় তাদের ঋণ নবায়ন করা যাবে। ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ এককালীন নগদ পরিশোধ করতে হবে। ঋণ নবায়নের আবেদন করার আগে যদি কোনো কিস্তি পরিশোধ করে থাকেন তবে তা ডাউন পেমেন্ট হিসাবে গণ্য হবে না। আবেদনের সময় আলাদা করে ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে। এর আওতায় খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য নবায়ন করা যাবে। এক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের জন্য গ্রাহক দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড পাবেন। নবায়ন করা ঋণ প্রতি মাসে একটি কিস্তি বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে একটি কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণের ওপর ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাংক ঘোষিত সুদহারের চেয়ে এক শতাংশ কম সুদ আরোপ করা যাবে। গ্রেস পিরিয়ড চলার সময়ে আরোপিত সুদ ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ আদায় করা যাবে।
গ্রাহক একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে নবায়ন করা ঋণ আবার খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবে। সেক্ষেত্রে আলোচ্য সুবিধায় ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে। এ ধরনের গ্রাহককে ব্যাংক স্বীয় বিবেচনায় নতুন ঋণ দিতে পারবে এবং আগের দেওয়া ঋণ সীমাও বাড়ানো যাবে।
সার্কুলারে বলা হয়, কোনো ঋণগ্রহীতা বিশেষ এক্সিট সুবিধা নিতে চাইলে ১০ বছরের অতিরিক্ত আরও এক বছর সময় পাবেন। এর মধ্যে পুরো ঋণ পরিশোধ করে এক্সিট সুবিধা নিতে পারবেন। নিয়মিত ঋণকে বিশেষ এক্সিট প্রদানের ক্ষেত্রে এক্সিট চলাকালীন আরোপিত সুদ ব্যাংকার-গ্রাহক স¤পর্কের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বা আংশিক আদায় করা যাবে। অর্থাৎ ব্যাংক ইচ্ছা করলে কিছু সুদ মওকুফ করতে পারবে।
গ্রাহককে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন করতে হলে এ নীতিমালার আওতায় ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। আবেদন গ্রহণের তারিখ থেকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে ব্যাংক কর্তৃক তা নিষ্পত্তি করতে হবে। নীতি সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট চেক বা অন্য কোনো ইনস্ট্রুমেন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হলে তা নগদায়নের পর থেকে বর্ণিত ৬ মাস গণনা করতে হবে। তবে, ডাউন পেমেন্টের অর্থ ব্যাংকের অনুকূলে নগদায়নের পূর্বে নীতি সহায়তার আবেদন কার্যকর করা যাবে না।
সার্কুলারে বলা হয়, এ নীতিমালার আওতায় কোনো গ্রাহকের ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। ব্যাংক কর্তৃক নীতি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি গ্রহণ করতে হবে না। একাধিক ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের বিপরীতে নীতি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক বা সবার সম্মতিতে ঋণদানকারী যে কোনো ব্যাংক নীতি সহায়তা প্রদানের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।
সার্কুলারে বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান যারা আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বলে প্রতীয়মান হয় তাদের এ নীতিমালার আওতায় সহায়তা প্রদান করা যাবে। বিগত সময়ে ঋণ এবং ঋণসংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং ও আনুষঙ্গিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত এবং অব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে (যেমন-দৃষ্টিভঙ্গিজনিত বৈষম্যের শিকার হওয়া ও প্রতিশ্রুত ইউটিলিটি সংযোগ/সরবরাহ না পাওয়া ইত্যাদি) ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান এবং সচল রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও সুবিধা দেওয়া যাবে। বিবিধ কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্নতা থেকে সৃষ্ট অভিঘাত ও বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার অপ্রত্যাশিত বিনিময় হারজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, নীতি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বে ঋণ পুনঃতফশিলিকরণ, পুনর্গঠন ইত্যাদি কোনো রূপ নীতি সহায়তা প্রাপ্ত হননি এরূপ ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে।