সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা কমার কোনো লক্ষণ নেই

0
29

বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী ভারতের স্থল সীমান্ত সবচেয়ে বেশি। কিন্তু প্রায় সময়েই নানা কারণে বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা প্রশ্নও উঠছে। সীমান্তে অব্যাহত ভয়াবহ সহিংসতায় বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।

গত দুই বছরে হতাহতের সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় সীমান্ত এলাকায় চলমান উত্তেজনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দফতরের ২০২৩ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ওই বছর সীমান্তে পৃথক ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৫ জন বাংলাদেশী।

এর মধ্যে ১৯ জন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এবং বাকি ছয়জন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

এই ঘটনাগুলো বিএসএফ সদস্যদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার এবং স্থানীয় ভারতীয় বাসিন্দাদের জড়িত বিক্ষিপ্ত সহিংসতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে অর্থাৎ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য বিএসএফের মহাপরিচালকের কাছ থেকে বছরের পর বছর ধরে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও, প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে বিএসএফ, যার ফলে বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রাণহানি ঘটছে।

২০২৪ সালে এই প্রবণতা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বিজিবি সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গেল বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিএসএফের হাতে আরো ১৯ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। আর এসব নিহত আগের বছরের একই ধরনের সহিংসতার ধারাবাহিকতা।

এ ছাড়া বছরটিতে ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের হাতে আরো পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব হতাহতের কারণে উভয় সরকারের ক্ষোভ ও জবাবদিহিতার দাবিকে আরো বাড়িয়েছে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো দেশ দুটির সরকার পর্যায় ও বাহিনী পর্যার্য়ে ধারাবাহিক আলোচনা চললেও ২০২৫ সালেও হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। প্রথম দুই মাসে, ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, আরো তিনজন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন। আরো এসব নিহতদের মধ্যে– একজন বিএসএফ সদস্যদের হাতে এবং দুজন ভারতীয় নাগরিকের হাতে প্রাণ হারান।

সর্বশেষ এই প্রাণহানিগুলো অর্থনৈতিক সুযোগ, অভিবাসন বা বাণিজ্যের সন্ধানে সীমান্ত অতিক্রমকারী ব্যক্তিদের চলমান ঝুঁকির কথা তুলে ধরে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার উদ্বেগের জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলে বসবাসকারীদের জীবনকে প্রভাবিত করছে ঘন ঘন সহিংসতা। এসব অঞ্চলে অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম এবং আঞ্চলিক বিরোধের খবরও পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো উভয় দেশকে উত্তেজনা কমাতে, সীমান্ত সুরক্ষা প্রোটোকল জোরদার করা এবং সহিংসতার জন্য দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

তবে বিস্ময়ের ব্যাপপার হলো সাম্প্রতিক প্রাণহানির বিষয়ে এখন পর্যন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে এর আগের ঘটনাগুলোর ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। সীমান্তে চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হস্তক্ষেপ ও চাপ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো।

নিহতদের পরিবারের জন্য, সহিংসতা একটি স্থায়ী দুঃখের কারণ এবং যার কোনো সমাধান নেই। মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং আরো নিরাপদ ও মানবিক সীমান্ত নীতির বাস্তবায়নে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের ওপরই চাপ বাড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম শফিকুর রহমান বলেন, গত ১০ বছরে ২২০ জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতের বিএসএফ। এছাড়া একই সময়ে ভারতীয় নাগরিকদের হাতে নিহত হয়েছেন আরো ৫৭ জন বাংলাদেশী।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল রহমান জোর দিয়ে বলেন, বিজিবি সদস্যরা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার নীতমালা কঠোরভাবে মেনে কাজ করে। ‘যদি কোনো ভারতীয় নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তাহলে আমরা তাদের আটক করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করি অথবা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্থানীয় থানায় হস্তান্তর করি। আমরা কখনও গুলি চালাই না, যে কারণে আমাদের সীমান্তে বিজিবির হাতে কোনো ভারতীয় নাগরিকের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যখনই বিএসএফের সাথে বৈঠক করি, কমান্ডার স্তরে হোক বা অন্য কোনো স্তরে, আমরা বারবার তাদের অনুরোধ করি যে, যদি কোনো বাংলাদেশী অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে তাহলে তাদেরদের উপর গুলি না চালাতে। বরং তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা উচিত।’

সীমান্তে বিএসএফের প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে কঠোর অবস্থান নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।

বিজিবির নজরদারির পরও বাংলাদেশী নাগরিকরা কিভাবে সীমান্ত অতিক্রম করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে ৯৯ শতাংশ ঘটনা চোরাচালান সংক্রান্ত। সীমান্তের দুই পাশেই রয়েছে চোরাচালান সিন্ডিকেট। যারা চোরাচালানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা প্রায়ই ভারতীয় অংশের সিন্ডিকেট সদস্যদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এরপর যখন তারা ফিরে আসতে থাকে তখন তারা বিএসএফের প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। এসময় সহিংস সংঘর্ষ হয় যেখানে বিএসএফ সদস্যরা বেশিরভাগ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে ভারতীয় নাগরিকরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে আমরা মানবাধিকার আইন মেনে চলি। গুলি চালানোর পরিবর্তে আমরা তাদের আটক করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করি।’

শফিকুর রহমান আরো উল্লেখ করেন, সীমান্ত ফাঁড়িগুলোর (বিওপি) মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি বিওপি ২০ থেকে ৩৫ জন সদস্য নিয়ে পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, ‘সারা দেশে বিজিবির প্রায় ৭০০টি দল রয়েছে। যারা সবসময় সীমান্তে টহল দিয়ে থাকে। তবে তা যথেষ্ট নয়। ফলে বিজিবির প্রতিরোধের শতচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু বাংলাদেশী নাগরিক অজান্তেই সীমান্ত অতিক্রম করে।’

ভারতে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম রোধে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, বিজিবি সীমান্ত অতিক্রম নিরুৎসাহিত করতে এবং এর ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্নভাবে সীমান্ত এলাকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করছে।

কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকয় সীমান্ত সম্পর্কিত হতাহত রোধের বিষয়টি অগ্রাধিকারে রয়েছে। উভয় দেশকে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এবং সীমান্তে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

সূত্র : ইউএনবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here