ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে চলছে নানা সমীকরণ। নিজ নিজ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছে প্রতিটি রাজনৈতিক দল। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না—এমনটি ধরে নিয়েই এগোচ্ছে সবাই। দেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ না থাকলে ভোটের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে বিএনপির। কিন্তু চিরাচরিত সেই হিসাব পাল্টে দিতে কয়েক মাস ধরে নানা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দল দুটির নেতৃত্বে বিএনপিকে ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ জানাতে ইসলামভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর নির্বাচনী মোর্চা বা জোট গড়ে তোলার লক্ষ্যে চলছে দৌড়ঝাঁপ। এই জোট গঠনের মূল লক্ষ্য—সমানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচন আদায় এবং আগামী সংসদে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলা। এজন্য ইসলামী দলগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতিটি আসনে একক প্রার্থী দাঁড় করাতে চায়। এ নিয়ে সমঝোতার জন্য ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ধারাবাহিক আলোচনা চলছে। নির্বাচনী জোট এবং সমঝোতার বিষয়টিকে প্রতিটি দলই গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান দায়িত্বশীল নেতারা। তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কবে আসবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না কেউ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচনী জোট গঠনের ক্ষেত্রে নিবন্ধিত এবং ভোটের মাঠে অবস্থান রয়েছে এমন দলগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের উদ্যোগে এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে সব মিলিয়ে অন্তত আটটি ইসলামভিত্তিক দল। এ ছাড়া এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) এ আলোচনার মধ্যে রয়েছে। জোট গঠনের ক্ষেত্রে নির্বাচনী সমঝোতা বিষয়ক আলোচনার জন্য এসব দলের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা নীতিনির্ধারণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাশাপাশি দেশের চলমান পরিস্থিতিও পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। বিশেষ করে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন-পরবর্তী প্রেক্ষাপট অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিটি দল। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হলেও জোট বা সমঝোতার বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দায়িত্বশীল নেতারা বলছে, জোট গঠনের প্রক্রিয়া মূলত নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর দৃশ্যমান হবে।
এদিকে রাজনৈতিক দল না হয়েও ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ভোটের মাঠেও এ সংগঠনটির বিশেষ আধিপত্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। ইসলামী দলগুলোর জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত হেফাজতের সম্পৃক্ততার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে হেফাজতের প্রবীণ ও অধিকাংশ তরুণ নেতারা ইসলামী জোটে সম্পৃক্ত হওয়ার পক্ষে। তবে হেফাজতের আমিরসহ প্রবীণ নেতাদের একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে জোট করার পক্ষে বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামী দলগুলো বহুদিন ধরেই একটি ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে লড়তে চায়। তবে ইসলামী দলগুলোর অতীত ঐক্যের ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়, তাই তারা এ নির্বাচন ঘিরে ঐক্য গড়তে চাইলে আদতে তা কতটা সফল হবে, নাকি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। অন্যদিকে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের জোট গঠনের তৎপরতাকে টেক্কা দিতে বিএনপিও সমমনা ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। বিএনপির এ উদ্যোগের ফলে ইসলামী দলের জোট গঠনের উদ্যোগ চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, আসন্ন নির্বাচন ঘিরে ইসলামী দলগুলোর জোট গঠনের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কেননা, বর্তমানে ডাকসু, জাকসুসহ দেশের বিভিন্ন বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চলছে। নির্বাচন-পরবর্তী পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে ইসলামী জোট গঠনের লক্ষ্যে লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা আলোচনা, পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমন্বয় অব্যাহত রেখেছেন। যথা সময়েই নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। এই জোটে কারা কারা থাকছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রধানত ইসলামী দলগুলোকে নিয়েই নতুন জোট হওয়ার কথা। তারপরও আলোচনার মাধ্যমে সমমনা দলগুলোও জোটে থাকতে পারে। সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে এ বিষয়টি দৃশ্যমান হবে বলে মনে করেন মাওলানা হালিম।
এ বিষয়ে কালবেলার কথা হয় আরও কয়েকটি ইসলামী দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে। তারা জানান, বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে বেশিরভাগ ইসলামী দল নানাভাবে জুলুম-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এখন চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশকে বিবেচনায় নিয়ে আদর্শিক দ্বন্দ্ব ভুলে বৃহত্তর স্বার্থে এক হওয়ার জন্য ঐক্যের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন তারা। জামায়াতকে নিয়েই এই ইসলামী জোটের সমীকরণ এগোচ্ছে। মূলত গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই ইসলামী দলগুলোকে অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আনার আলোচনা শুরু করে জামায়াত। এরপর এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় ইসলামী আন্দোলন। এরই মধ্যে বেশ কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। তবে আসন সমঝোতার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত প্রতিটি দল নিজস্ব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। তবে সামগ্রিক ঐক্যের ব্যাপারেও তারা আশাবাদী।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা হলে তাতে অন্তত ৮টি ইসলামী দল থাকতে পারে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত আন্দোলন। ঐক্য গড়তে দলগুলোর লিয়াজোঁ কমিটিও কাজ করছে। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি দলের ভেতরে চলছে জোরালো আলোচনা। এ ছাড়াও এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ এবং এনসিপিও সমঝোতায় আসার ক্ষেত্রে আলোচনায় রয়েছে। এই দলগুলোর দায়িত্বশীল পর্যায়ের নেতারা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তবে এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের দাবি, ইসলামী দলগুলোর সমঝোতা প্রক্রিয়ায় তাদের থাকা না থাকা নিয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।
ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান কালবেলাকে বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে আমরা ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে একক প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা করছি। ইসলামী দলগুলো সমন্বিতভাবে একক প্রার্থী দিতে পারলে জয়ের সম্ভাবনা বেশি। নির্বাচনী সমঝোতা হলে যেসব দল নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে তারা নিজ দলের প্রার্থীদের প্রত্যাহার করবেন। নির্বাচনের রোডম্যাপ বা তপশিল ঘোষণা হলে বিষয়টি দৃশ্যমান হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা একাধিক বৈঠক করেছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে লিয়াজো কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট এবং বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের দায়িত্বশীল নেতারা অংশ নেন। তবে সেখানে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক গতকাল কালবেলাকে বলেন, আমরা এখন সবাই একসঙ্গেই চলছি। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা মাঝে-মধ্যে হচ্ছে। তবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি তথা তপশিল ঘোষণা হলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে আলোচনা চলমান আছে। আমাদের ৫টি দলের লিয়াজোঁ কমিটি আছে। একাধিক সভা হয়েছে, আরও হবে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নীতিগত কথা হয়েছে। সবাই একমত যে, জোটবদ্ধ হওয়া দরকার। নির্বাচনের তপশিল হলে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
ইসলামী দলগুলোর সম্ভাব্য জোট নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. সাহাবুল হক বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় ইসলামী দলগুলো বিএনপির বিপক্ষে একটি স্বতন্ত্র জোট গঠনের চেষ্টা করছে, যা রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। যদি তারা সংহত ও শক্তিশালী জোট গঠনে সক্ষম হয়, তবে তারা ঐতিহ্যবাহী ভোট ব্যাংক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করতে পারবে এবং সংসদে ভালোসংখ্যক প্রতিনিধি পেতে পারে। তবে এই জোটের সাফল্য নির্ভর করবে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য, আদর্শিক স্পষ্টতা ও জনসমর্থনের ওপর। এটি ভবিষ্যৎ নির্বাচনী সমীকরণ বদলে দিতে পারে।