পায়ের জাদুতে ফুটবলবিশ্বের দুই যাদুকর

0
22
পায়ের জাদুতে ফুটবলবিশ্বের দুই যাদুকর
পায়ের জাদুতে ফুটবলবিশ্বের দুই যাদুকর

ভিড়ে ঠাসা স্টেডিয়াম। আলো ঝলমলে চারপাশ। নিঃশব্দে দোলা দিচ্ছে গ্যালারি… যেন পুরো পৃথিবী অপেক্ষা করছে। হঠাৎ, রেফারির বাঁশির শব্দ। অতঃপর, বল ছোঁয়া পায়ের ছন্দ।

একদিকে এক তরুণ, কাঁধ ঝুঁকিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছেন। পায়ের ছোঁয়ায় বল যেন জ্যামিতির নিয়ম ভুলে যাচ্ছে। অন্যদিকে, মাটিতে গর্জন তুলতে তুলতে এগিয়ে আসছে এক সৈনিক—চোখে বিদ্যুৎ, শরীরে আগুন; লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

মেসি যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক চিত্রকর্ম। তার প্রতিটি ড্রিবল, প্রতিটি পাস ছিল নিখুঁত সংগীতের মতো—শান্ত অথচ ধ্বংসাত্মক। রোনালদো ছিলেন মানব শরীরের সীমা ভেঙে ফেলার এক জীবন্ত অধ্যায়। তার প্রতিটি স্প্রিন্ট, প্রতিটি হেড, প্রতিটি গোল ছিল আগুন আর বরফের মিশ্রণ। একজন জন্মেছিলেন ফুটবলের প্রেমিক হয়ে। অন্যজন গড়ে তুলেছিলেন নিজেকে বলের শাসক হিসেবে।

পেলে থেকে ম্যারাডোনা, ক্রুয়েফ থেকে জিদান। অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে অনেকের তুলনা হয়েছে, অনেকের একসঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়েছে। কিন্তু মেসি ও রোনালদোর মতো এমন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবল ইতিহাসে এই প্রথম। এক যুগের বেশি সময় ধরে বিশ্ব ফুটবলে রাজত্ব করছেন এ দুই তারকা। কখনো এগিয়ে যান মেসি, আবার কখনো রোনালদো। দ্বৈরথের গল্প নয়, এটা ফুটবলের সবচেয়ে মহান যুদ্ধের গল্প।

২০০৪ সাল। ফুটবলবিশ্ব তখন নতুন কিছু খুঁজছিল। তখনই পৃথিবীর দুই বিপরীত মেরু থেকে উদিত হলো দুটি তারা। ছোটখাটো গড়ন, নিস্তব্ধ গতি, চোখে অদম্য নরম গর্জন নিয়ে হাজির হলেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। বল পায়ে যেন জন্মগত এক শিল্পী। অন্যদিকে মেদহীন শক্তি, দুর্দান্ত গতি, গোলের জন্য অমোঘ তৃষ্ণা নিয়ে ফুটবল জগতে পা রাখলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। যেন আত্মনিয়ন্ত্রণের এক জীবন্ত উদাহরণ। দুজন—দুইভাবে, কিন্তু ছুটছিলেন অমরত্বের দিকে।

ক্যাম্প ন্যু বনাম সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। মেসি বনাম রোনালদো। যখন একজন পুরো মাঠ ড্রিবল করে বল জালে পাঠান, আরেকজন উত্তর দেন আরও প্রবল ঝড়ে। একজন হ্যাট্রিকের দাবানল জ্বালালে, আরেকজন প্রতিপক্ষের ঘরের মাঠেই উঠিয়ে দিতেন বিদ্রোহের ঝড়। প্রতিটি এল ক্লাসিকো হয়ে উঠত একেকটা অগ্নিপর্ব। যেখানে শুধু গোল হয়নি, তৈরি হয়েছিল ইতিহাসের দালান, লেখা হয়েছিল কিংবদন্তির গল্প।

তীব্র লড়াইয়ের মাঝেও কখনও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি ছিল না। ছিল নিঃশব্দ সম্মান, চোখের ভাষায় অনুপ্রেরণা।

মেসি একবার বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো তার মতো শক্তিশালী নই, কিন্তু তার মতো দৃঢ় হতে চেয়েছি।’
রোনালদোও বলেছিলেন, ‘মেসি না থাকলে আমি হয়ত এতটা চেষ্টা করতাম না।’

এটাই আসল যুদ্ধ—যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীকে শ্রদ্ধা করে নিজেকে সেরা বানানো যায়। আজ তারা দুই ভিন্ন মহাদেশে, ভিন্ন সময়ের গল্প বলছেন। কিন্তু ফুটবল যখনই একটুখানি নিঃশ্বাস নেয়, ভক্তরা আজও খুঁজে ফেরে সেই পুরনো ঝড়ের ঘ্রাণ—মেসি বনাম রোনালদো। তারা দেখিয়ে দিয়েছে—তাদের জন্যই ফুটবল হয়ে উঠেছে কেবল খেলা নয়, এক দেশ, এক যুদ্ধ, এক কবিতা।

কখনো কখনো, পৃথিবী যেন বিভক্ত হয়ে যায় দুটি নামে—মেসি ও রোনালদো। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য—আমরা এমন এক সময়ের সাক্ষী, যেখানে দুজনেই একসঙ্গে জ্বলেছেন আকাশের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। দুজন ভিন্ন পথে, ভিন্ন ছন্দে শিখিয়েছেন কীভাবে সীমারেখা মুছে ফেলে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা যায়।

তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদের বুঝিয়েছে, সেরা হওয়ার চেয়ে বড় কথা হলো নিজেকে প্রতিদিন ছাড়িয়ে যাওয়া। নিজেকে হারিয়ে জয়ের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা। দুই মহারথীর এ গল্প চিরকাল বয়ে যাবে ফুটবলের প্রতিটি শিরায়, প্রতিটি শিরোনামে, প্রতিটি স্বপ্নে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here