কম্বোডিয়ায় বিতর্কিত নির্বাচনের পর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, কী চায় বাইডেন প্রশাসন?

0
113

কম্বোডিয়ায় রোববার নির্বাচনের পর ওই নির্বাচনকে ‘মুক্ত বা নিরপেক্ষ, কোনোটাই নয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন।

নির্বাচনে ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা হুন সেনের দল কম্বোডিয়ান পিপল’স পার্টি (সিপিপি) প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায়। নির্বাচনের আগে সিপিপি’র একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যান্ডললাইট পার্টিকে নিষিদ্ধ করায় কার্যত একপক্ষীয় নির্বাচনই হয়।

নির্বাচনের রাতেই যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে জানান যে নির্বাচনের জের ধরে কম্বোডিয়ায় যারা ‘গণতন্ত্রকে অবমূল্যায়ন’ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

নির্বাচনের আগে কম্বোডিয়ার কর্তৃপক্ষ ‘রাজনৈতিক বিরোধী, মিডিয়া ও সুশীল সমাজের সদস্যদের হুমকি ও হয়রানিমূলক আচরণ করে’ দেশের সংবিধানের চেতনা ক্ষুণ্ণ করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কম্বোডিয়ার দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।

কী বলছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট?
স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় কারা থাকবেন এবং কম্বোডিয়ার সরকারের কেউ থাকবেন কিনা।

এই প্রশ্নের জবাবে মিলার বলেন, ‘নীতিগত অবস্থানের কারণে নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা কারো নাম আমরা উল্লেখ করি না। আমরা শুধু জানাই যে নির্দিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাকে আমরা চিহ্নিত করেছি।’

কম্বোডিয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও ‘গণতন্ত্রের অবমূল্যায়নে জড়িত থাকা’ এবং ‘কম্বোডিয়া সরকারের গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপের সরাসরি প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেবার ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এসেছিল সে সময়কার একমাত্র কার্যকর বিরোধী দল সিএনআরপিকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর।

কম্বোডিয়ায় ভিসা নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস
কম্বোডিয়ায় ২০১৩ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে প্রথমবার ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটির ওপর।

ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সিপিপি’র ৬৮টি আসনের বিপরীতে বিরোধী দল সিএনআরপি ৫৫টি আসন পায়। নির্বাচনের পর বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে।

বিরোধী দল সিএনআরপি সংসদে আসন গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং ২০১৪ সালের শুরু পর্যন্ত এক বছর ধরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ চালায়।

ক্ষমতাসীন দল কঠোরভাবে এই বিক্ষোভ দমন করে এবং সিএনআরপি শেষ পর্যন্ত এই শর্তে সংসদে যোগ দেয় যে পরবর্তী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সরকার সংশোধন আনবে।

কিন্তু এর পরের বছরগুলোয় সরকার বিরোধীদের ওপর আরো কঠোরভাবে দমন করে। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট সিএনআরপি’কে নিষিদ্ধ করে এবং দলের সদস্যদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল করে।

এর পরই প্রথমবারের মতো কম্বোডিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ওপর এবং বিভিন্ন বাণিজ্য সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র।

এরপর ২০১৯ সালে চীনের সহায়তায় কম্বোডিয়ার একটি নৌবাহিনীর ঘাঁটি তৈরির খবর প্রকাশিত হলে আবার নিষেধাজ্ঞা আসে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে।

আর ২০২১ সালে কম্বোডিয়ায় কাজ করা চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র – যেই প্রতিষ্ঠানটি থাইল্যান্ডের উপসাগরের কাছে দারা সাকোর অঞ্চলে চীনা বিমান বাহিনীর ব্যবহারের জন্য এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করছিল।

সবশেষ রোববারের নির্বাচনের পর কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে আরেক দফা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলো যুক্তরাষ্ট্র।

বিভ্রান্তিকর ভিসানীতি?
কম্বোডিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ২০২২ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো গ্রেগরি পোলিং, সহকারী ফেলো চার্লস ডুন্সট ও সহকারী গবেষক সিমোন ট্রান হিউডস।

তাদের গবেষণা অনুযায়ী, কম্বোডিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব স্ববিরোধী। কম্বোডিয়াকে তাদের অগণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ নাকি ভূ-রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ – এই দোটানায় কম্বোডিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি দোদুল্যমান রয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা।

২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে মোট ২৮টি, যার মধ্যে ২৬টিই একটি নির্দিষ্ট আইনের অধীনে। গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্টের (জিএমএ) আওতায় বিশ্বের যেকোনো জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে তারা।

গবেষকদের মতে, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কম্বোডিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা ও দুর্নীতি প্রতিরোধই যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য।

কিন্তু ২০২১ সালে চীনা বিমান বাহিনীর জন্য এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জিএমএ’র অধীনে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বোঝা যায় যে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতির চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

এই নিষেধাজ্ঞার আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ‘কম্বোডিয়ায় ক্ষতিকর চীনা বিনিয়োগ’ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি বিবৃতিও প্রকাশ করে।

আবার ২০১৯ সালে চীনের সহায়তায় নৌঘাঁটি তৈরির জের ধরে কম্বোডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরই আবার দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পদক্ষেপ নেয়।

আর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ২০২২ সালের মে মাসে ‘ইউএস-আসিয়ান স্পেশাল সামিটে’ অংশ নিতে গিয়ে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন তিন দশকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দেখা করেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও গত নভেম্বরে আসিয়ান-ইউএস বৈঠকে অংশ নিতে কম্বোডিয়া সফর করেন।

গবেষকদের মতে, কম্বোডিয়া সম্পর্কে কৌশল নির্ধারণে ওয়াশিংটনকে আরো দূরদর্শিতা অবলম্বন করতে হবে। এখনকার মতো নিষেধাজ্ঞাভিত্তিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অব্যাহত থাকলে কম্বোডিয়ায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে না এনে হুন সেনের স্বৈরশাসনকেই অন্যভাবে দীর্ঘায়িত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন গবেষকরা।

সূত্র : বিবিসি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here