top-ad
২৭শে জুলাই, ২০২৪, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১
banner
২৭শে জুলাই, ২০২৪
১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১

জীবনের রানী চক্রের এলোমেলো গল্প

জীবনের এমন একটা সময় ছিল যখন বসন্তের বাতাস, কোকিলের ডাক, চাঁদের আলো কিংবা বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দে মাতোয়ারা হয়ে যেতাম। গল্প-উপন্যাস কবিতার বই কিংবা দেশী-বিদেশী ম্যাগাজিন নিয়মিত পড়া এবং সেগুলোকে নিত্যসঙ্গী করা জীবনের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নতুন কিছু অধ্যয়ন- শিয়রে বই পুস্তক রাখা অথবা ভ্রমণে বিদ্যাসামগ্রীকে সঙ্গী করা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। শরীরচর্চা-খেলাধুলা-সঙ্গীত-নাট্যকলা, সিনেমা-থিয়েটার ছাড়াও আবহমান বাংলার জারি সারি-নৌকা বাইচ প্রভৃতি ক্রীড়া-কর্মের নিয়মিত কর্মী হিসেবে যে সময় পার করেছি তা ২০২৩ সালে এসে স্মরণ করতেও ভয় লাগে।

আমার মতো যারা ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে অজো পাড়াগাঁয়ে জন্মেছিলেন এবং জীবনের বহু ধাপ পেরিয়ে লন্ডন আমেরিকা ঘুরে এসে ঢাকাতে বসতি স্থাপন করে দেশপ্রেমের মহান সৈনিক হিসেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন তারা তখন জীবন-জীবিকার জাঁতাকলে পড়ে কতটা আর্তচিৎকার করতে পারেন সেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। পেটের চিন্তা-মস্তিষ্কের চিন্তা, শরীর ও মনের চিন্তার জটিল রসায়ন এবং অশান্ত সময়ের সব বিরূপ পরিস্থিতি মানুষকে কিভাবে অমানুষ বানিয়ে ফেলছে অথবা জীবিত মানুষকে কিভাবে অনুভূতিহীন মৃত মানুষে রূপান্তরিত করে ফেলছে সেই কাহিনী ফুটিয়ে তোলার সাধ্য আমার নেই। স্বৈরাচারীদের কপাল ভালো যে, বর্তমান জমানায় কোনো শরৎচন্দ্র-সুকান্ত কিংবা কাজী নজরুল নেই। অথবা শিল্পাচার্য জয়নুলের মতো বা পটুয়া কামরুল হাসানের মতো কেউ নেই যারা তুলির আঁচড়ে জীবন-ইতিহাস রচনা করার সক্ষমতা রাখেন।

বাজারে দ্রব্যমূল্যের আগুন মাছ- গোশতের দামের কাহিনী রোজ যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে আমি যদি বলি এরশাদ জমানায় ১৯৮৬ সালে গরুর গোশতের কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা ছিল। তবে কয়জন আমার কথা বিশ্বাস করবেন। ঢাকা শহরে সেই জমানায় এক হাজার টাকা রোজগার করতে পারলে তিন-চারজনের একটি সংসার দিব্যি আরাম-আয়েসে চলতে পারত। আমি যখন ঢাকাতে প্রথম সংসার শুরু করেছিলাম তখন জীবনযাত্রার যে ডাটফাট ছিল তা হাল আমলে কল্পনাও করা যায় না। প্রতি বেলা খাবারে আট-দশ প্রকারের ভাজি-ভর্তা-তরিতরকারি না হলে আমার চলত না। কাটারিভোগ চালের সুবাসিত ভাত, খাঁটি গরুর দুধের সরসহ ঘন ও গাঢ় করে পাকানো দুধের সাথে দেশী-সবরী কলা দিয়ে দুধ-ভাত দিয়ে খাদ্য শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়ার সেই স্মৃতি আর কতদিন স্মরণে রাখতে পারব তা বলতে পারব না।

কয়েক দিন আগে সাভারের একটি গ্রামে কয়েক দিন থেকে এলাম। গ্রামের সাদামাটা যে সেলুনটিতে চুল কাটালাম সেখানে কর্মরত একমাত্র নরসুন্দরের করুণ কাহিনী শুনে জীবনের হিসাব মিলাতে পারলাম না। তার স্ত্রী একটি গার্মেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করেন। প্রতিষ্ঠানটিতে গত এক বছর ধরে কাজকর্ম তেমন একটা নেই। ছয় হাজার লোকবলের বিশাল কারখানাটির বেশির ভাগ শ্রমিক সারাদিন কর্মহীন বসে থাকেন। কর্তৃপক্ষ দুই-তিন মাস পর একবার বেতন দেন। কর্মীরা ছুটিছাঁটার দরখাস্ত করলে মালিক পক্ষ সাথে সাথে মঞ্জুর করেন এবং একদিনের স্থানে দশ দিন ছুটি দিয়ে দেন। অন্য দিকে নরসুন্দর নিজে সাকুল্যে আট দশ হাজার টাকার বেশি উপার্জন করতে পারেন না। এই অবস্থায় চার সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি কিভাবে চলেন তা আর জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না।

নরসুন্দরের কথা শুনে মন ভারী হয়ে উঠল। প্রথমত. তার স্ত্রী যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সেটির মালিক পক্ষ আমার পরিচিত। বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। সাভারে বেড়াতে যাওয়ার কিছুদিন আগে সেই গার্মেন্ট মালিকের মেয়ের বিয়েতে সপরিবারে নিমন্ত্রিত ছিলাম। বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা আদর আপ্যায়নের বিলাসিতায় আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম এমন একটি অনুষ্ঠানে কত টাকা খরচ হতে পারে- দশ কোটি কিংবা পনেরো কোটি! অনুষ্ঠানের জাঁকজমক এবং শিল্পপতির উচ্ছ্বাস দেখে আমার মনে হয়েছিল, পুরো গার্মেন্ট সেক্টরে ব্যবসার মন্দা চললেও ভদ্রলোকের ব্যবসা হয়তো ভালো। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সময় সুযোগ করে ভদ্রলোকের সাথে ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করব এবং বিরূপ সময়ে তার সফলতার নেপথ্য কারণগুলো শুনব। কিন্তু সাভারের নরসুন্দরের কথা শোনার পর আমার মনটা ভদ্রলোকের জন্য হু হু করে কেঁদে উঠল। নিজের শত অভাব আড়াল করে কেবল চল্লিশ বছরের সফলতাকে যেন কেউ তাচ্ছিল্য করতে না পারে সেজন্য ঋণ করে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানস্থলে তিনি এক বুক কান্না নিয়ে আমাদের সামনে অনবরত হেসেই চলেছিলেন।
উপরিউক্ত ঘটনার মতো প্রায় হুবহু আরেক ঘটনার কথা না বললে আমাদের ধনিক শ্রেণীর বেদনা অনুভব করতে পারবেন না। আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে হলো মাস তিনেক আগে। আকদ, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হলো যথাক্রমে র‌্যাডিসন ও শেরাটনে। বিয়ের অনুষ্ঠান হলো সেনাকুঞ্জে। বন্ধুর ফ্যাক্টরিতে আরেকটি অনুষ্ঠান হলো যেখানে পাঁচ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীকে বিয়ের খাবার খাওয়ানো হলো। চারটি অনুষ্ঠানে কম করে হলেও দশ কোটি টাকার মতো খরচ হয়ে গেল। আমি বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি দুঃসময়ে এত বিশাল ব্যয়ের ঝক্কিঝামেলা করতে গেলেন, যেখানে গত এক বছর ধরে তিনি ক্রমাগত ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন এবং ব্যবসায় লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন।

আমার কথা শুনে বন্ধুটি কষ্টে হাসি দিলেন এবং নিজের জীবনের নির্মম বাস্তবতার কথা শোনালেন। তার মতে, আমাদের সমাজ দারিদ্র্যকে সহ্য করে না। দুর্বলের স্থান সর্বদা পায়ের তলায়। কেউ যদি টের পায় যে, ধনী ব্যক্তির ধন সঙ্কট চলছে ওমনি সবাই মিলে তাকে দরিদ্র বানানোর জন্য চেষ্টা-তদবির শুরু করবে। অন্য দিকে ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজ অফিসের কর্মচারী থেকে শুরু করে কাস্টমার, এজেন্ট, ব্যাংক, বীমা সরকারের রাজস্ব বিভাগ অথবা গুণ্ডা-মাস্তানরা যদি টের পায় যে, কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকের আর্থিক দুরবস্থা শুরু হয়েছে তবে সবাই সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেবে। ফলে সব বড় ব্যবসায়ীকে কৌশলে সারাক্ষণ গাল ফুলিয়ে রাখতে হয়, অর্থাৎ গাড়ি-বাড়ি, জামা-কাপড় ইত্যাদিতে ফুটানি প্রদর্শন করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়।

আমি জানি না, এই মুহূর্তে সারা বাংলাদেশে ঠিক কতজন শিল্পপতি আমার বন্ধুর মতো গাল ফুলিয়ে শেষ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন! তবে পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী দেশের পুরো আর্থিক খাতে যে মন্দা চলছে তাতে দেশের করপোরেট জগৎ জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে চলেছে। বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠান-ব্যাংক বীমা থেকে শুরু করে- পাড়া মহল্লার খুদে ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, ধোপা-নাপিত, দিনমজুর থেকে শুরু করে চাঁদাবাজ-ঘুষখোর-ছিনতাইকারী সবার হিসাবের খাতায় টান পড়েছে। যাদের সঞ্চয় ছিল তারা সেগুলো ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছেন আর যাদের সম্পদ রয়েছে তারাও বিক্রি বাট্টা করে দিনকে দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হওয়ার পথে অবিরত ছুটে চলেছেন।

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রতিদিন অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের চাহিদা সীমিত করে চলেছেন। ফলে ছিন্নবস্ত্রের হাড় জিরজিরে দুর্বল লোকের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েই চলেছে। শ্রমজীবীর শ্রম দেয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবী ক্রমেই বেআক্কল হয়ে যাচ্ছেন। লোভী ও সুবিধাভোগীরা নির্মম ও হিংস্র হয়ে পড়েছেন। ক্ষমতাধররা অধৈর্য ও অত্যাচারী গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছেন। মানুষের মেধা ও মননশীলতায় মড়ক লেগেছে। ফলে চার দিকে, হৈ হুল্লোড়, অস্থিরতা, হাঁকডাক ও মারামারি-কাটাকাটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু লোকের জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছে আর অন্য দিকে কিছু লোকের জবান লাগামহীন হয়ে পড়েছে।

উল্লেখিত অবস্থায় আমার শৈশব-কৈশোরের আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ মাঝেমধ্যে আমার মনে এক ধরনের নস্টালজিয়া সৃষ্টি করে। অতীতের সুন্দর দিনগুলোতে দেহ-মনে যে প্রশান্তি ছিল কিংবা মস্তিষ্কের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার যে আয়োজন ছিল তা হাল আমলে সমাজ-সংসার রাষ্ট্র থেকে রীতিমতো উঠে গেছে। ফলে আকাশে আগের মতোই চাঁদ আছে কিন্তু জোৎস্না দেখার লোক নেই। কোকিলেরা আগের মতোই গান গায় কিন্তু কোকিলের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে কোনো শিশু টুটু শব্দে গলায় সুর তোলে না। নদীতে জোয়ার আসে- নৌযান চলে কিন্তু কোনো মাঝি আগের মতো গান গেয়ে ওঠে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

আরো খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

জনপ্রিয় খবর