বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় অনেকদিন ধরে পশ্চিমা কূটনীতিকরা সরব থাকলেও এতদিন অনেকটাই চুপ ছিল প্রতিবেশী ভারত।
সেই নীরবতা ভেঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্র দফতর বৃহস্পতিবার বলেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন কিভাবে হবে সেটি দেশটির জনগণই ঠিক করবে।
একই সাথে ‘শান্তি থাকবে, সহিংসতা থাকবে না এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ এমন আশা ব্যক্ত করে ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে নির্ধারণ করবে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেভাবেই হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি বলছেন ভারত বিষয়টি নিয়ে নীরব থাকছে কারণ এসব বিষয়ে দেশটি সরাসরি প্রকাশ্যে কথা বলতে পছন্দ করে না।
তবে তার বিশ্বাস আগামী নির্বাচন যেন কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেটিই চাইবে ভারত এবং এ বার্তাই ফুটে উঠেছে পররাষ্ট্র দফতরের ভাষ্যে।
তবে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন যে, ভারত প্রকাশ্যে না বলে বরাবরই ভেতরে ভেতরে নিজেদের মতো করে কাজ করে। প্রকাশ্যে তাদের পররাষ্ট্র দফতর যাই বলুক না কেন ভারত তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য সচেষ্ট থাকবে বলেই মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ২০১৪ সালের ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটিতে ভারতীয় কূটনীতিকদের ভূমিকা ছিল অনেকটাই প্রকাশ্য।
বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের অনেকে ২০১৪ সালের বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন সফল করা ও ২০১৮ সালে প্রায় সব আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রকাশ্যেই ‘ভারতের একতরফা সমর্থনের’ কথা উল্লেখ করেন।
এসব কারণে সামনের নির্বাচন নিয়ে ভারতের ভূমিকা কেমন হয় তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল আছে।
কী বলেছেন ভারতীয় মুখপাত্র
বৃহস্পতিবার প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন পরিকল্পিত ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে ভারত আশা করছে।
বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি করে আসছে সে বিষয় অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
‘সেখানে কিভাবে নির্বাচন হবে তা বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে,’ বলেন তিনি।
ঢাকায় পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের তৎপরতা ও মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে পুরো বিশ্বই মন্তব্য করতে পারে, তবে ভারত ভারতই। বাংলাদেশের সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে যা ঘটে, তাতে আমরাও জড়িত, কারণ তা আমাদের প্রভাবিত করে…। বাংলাদেশের মানুষ নির্ধারণ করবে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেভাবেই হওয়া উচিত।
বাগচি বলেন, তারা অবশ্যই বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
সেখানে আমাদের একটি হাইকমিশন আছে। আমরা আশা করি সেখানে শান্তি থাকবে, সহিংসতা থাকবে না এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
কী ধারণা পেলেন বিশ্লেষকরা
ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রশ্নটি করেছিলেন সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী। লাহিড়ী বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ভারত-বাংলাদেশ বিষয়ক একজন বিশ্লেষকও।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে ভারতীয় মুখপাত্রকে তুলনামূলক সতর্কই মনে হয়েছে তার কাছে।
‘কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক কিছুই বলা হয় না। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অবাধ বা সহিংসতামুক্ত হোক এমন প্রত্যাশা ভারতের আছে। কিন্তু লক্ষ্য করবেন দু’বছর আগেও ভারত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলতো। যদিও ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক এবার সেই শব্দটি মুখপাত্র উল্লেখ করেননি, বলছিলেন লাহিড়ী।
যদিও ভারত ও বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা ভারতের একজন মুখপাত্রের মন্তব্যকে একেবারেই প্রাথমিক মন্তব্য হিসেবেই বিবেচনা করছেন।
কেউ কেউ মনে করছেন, ঢাকায় পশ্চিমারা যেভাবে তৎপরতা দেখান সেটি ভারতীয় কূটনীতিকদের কাজের ধরণ নয়, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
আবার বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখা যাচ্ছে আমেরিকা ও রাশিয়ার। অথচ দুটি দেশই আবার ভারতের ঘনিষ্ঠ।
অন্যদিকে ভারতের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ চীন আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানের দিকে সমর্থন প্রকাশ করেছে।
এসব কারণেই ভারত প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কোনো তৎপরতা না দেখালেও ভেতরে ভেতরে তাদের তৎপরতা বন্ধ নেই বলেই মনে করেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন।
‘ভারত সতর্ক থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত নিজের স্বার্থে যেটা ভালো হয় সেটাই করবে। আমরা তো জানি না যে ভেতরে ভেতরে তারা কী করছে। তবে তারা চুপ হয়ে আছে এটা ভাবার কারণ নেই কারণ বাংলাদেশে তাদের স্বার্থ আছে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ভারতীয় মুখপাত্র ব্রিফিংয়ে যা বলেছেন সেটিকে প্রাথমিক ও আনুষ্ঠানিক মন্তব্য হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতিকসহ অনেকেই মনে করেন, ভারতের একতরফা সমর্থনের কারণেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
বাংলাদেশে সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার দেব মুখার্জি বলছেন, ২০১৪ সালে ভারত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো হস্তক্ষেপ করেনি বরং তখন কিছু পশ্চিমা দেশ নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল বলে ভারত তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
‘এবার আমি মনে করি, ভারত চাইবে আগামী নির্বাচনটার ওপর কোনো সন্দেহ যেন না থাকে। সবসময় সরাসরি মন্তব্য ভারত করে না। আর সবকিছু প্রকাশ্যে বলা যায় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পশ্চিমা অনেক দেশের চেয়ে এখানে ভারতের স্বার্থ বেশি এবং সে কারণে তারা যা করার দ্বিপক্ষীয়ভাবে দুই সরকার মিলেই করবে, বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রের মন্তব্য প্রসঙ্গে।
পশ্চিমারা তৎপর কিন্তু ভারত চুপ
চলতি বছরের শেষ দিকেই বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে এ নির্বাচন কিভাবে হবে তা নিয়ে গত দুই নির্বাচনের মতো এবারো সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে প্রবল মতবিরোধ আছে।
বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে এ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়াম লীগ পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছে যে আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই।
দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির জের ধরে দেশে সহিংসতাও হচ্ছে মাঝে মধ্যেই। তবে এর মধ্যেই গত বেশ কয়েকমাস ধরে নির্বাচন নিয়ে বেশ সক্রিয় পশ্চিমা কূটনীতিকরা।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর ইতোমধ্যেই নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে বলেছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কেউ বাধাগ্রস্ত করলে তাকে ভিসা দেবে না দেশটি এবং এ ঘোষণার দৃশ্যমান প্রভাব হিসেবেই ঢাকাসহ সারাদেশে অনেকটা বাধাহীনভাবেই কর্মসূচি পালন করতে পারছে বিরোধী দলগুলো।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নিয়মিত বৈঠক করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে এবং সক্রিয় দেখা যাচ্ছে আরো অনেক পশ্চিমা কূটনীতিককে।
কিন্তু এতো ঘটনা সত্ত্বেও অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে নীরবতাই পালন করছিল বাংলাদেশের এ মুহূর্তে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ ভারত।
অবশেষে বৃহস্পতিবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছে ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি। আমেরিকা এবং পশ্চিমা কিছু দেশের মতো ভারতও একপর্যায়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যদি সরব হয় পরিস্থিতি যে তাহলে নতুন মাত্রা পাবে সন্দেহ নেই।
সূত্র : বিবিসি