সমস্যা বড় জটিল। তার সমাধান কবে হবে, এখন তা বলতে পারছে না কোনো পক্ষই।
গত বুধবার রাতের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে গেলেন মণিপুরের ৪০ জন বিধায়ক। মণিপুর বিধানসভার আসনসংখ্যা ৬০, তার মধ্যে বিজেপি বিধায়কদের সংখ্যা ৩২। বিজেপি-র নেতৃত্বে এই বিধায়করা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মীদের কাছে একটা স্মারকলিপি দিয়ে আসেন। সেখানে তাদের দাবি, মণিপুর থেকে অবিলম্বে আসাম রাইফেলসকে সরিয়ে দিতে হবে, কুকিদের সাথে যে সাসপেনশন অফ অপারেশন বা এসওও চুক্তি করা হয়েছিল তা বাতিল করতে হবে, এনআরসি চালু করতে হবে, কুকিদের আলাদা প্রশাসনের দাবি মানা যাবে না এবং সব অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
মণিপুরে যে কোনো মেইতেইয়ের সাথে কথা বলুন, জানতে চান, কিভাবে এই জটিল সমস্যার সমাধান হবে, তারা সকলে ঠিক এই দাবিগুলোই জানাবেন। আর আপনি যদি কুকিদের সাথে কথা বলেন, তাহলে শুনবেন, আসাম রাইফেলসকে কোনোভাবে সরানো যাবে না, মণিপুরের পুলিশ ও কম্যান্ডোদের পাহাড় থেকে সরাতে হবে, কুকিদের জন্য আলাদা প্রশাসন দিতে হবে এবং মেইতেইদের হাত থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং এসওও বাতিল করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
এসওও প্রসাথে পরে আসছি, আগে আসাম রাইফেলস ও মণিপুর পুলিশ ও কম্যান্ডোদের প্রসাথে আসি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব, মণিপুরের এই সংঘাতে আসাম রাইফেলস ও মণিপুর পুলিশ ও কম্যান্ডোদের নাম বারবার উঠে আসছে। কয়েকদিন আগেই আসাম রাইফেলসের নয় নম্বর ব্যাটেলিয়ানের বিরুদ্ধে মণিপুরের পুলিশ একটি এফআইআর করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আসাম রাইফেলস পুলিশকে তাদের কাজ করতে দিচ্ছে না। তারা সাঁযোয়া যান দিয়ে রাস্তা আটকে দিচ্ছে। অভিযুক্ত কুকি সন্ত্রাসীরা মেইতেইদের হত্যা করে পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট বলছে, কিছুদিন আগে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে পুলিশের সাথে আসাম রাইফেলসের উত্তেজিত বাক্য বিনিময় ছিল। আমরা এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করতে পারিনি। তবে পুলিশের এফআইআর পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে আসাম রাইফেলসের প্রতিক্রিয়াও বলে দিচ্ছে, পরিস্থিতি কোন জায়গায় গেছে।
দ্য ওয়্যার জানাচ্ছে, সেনার তরফে জানানো হয়েছে, কিছু শত্রুভাবাপন্নরা কেন্দ্রীয় বাহিনী বিশেষ করে আসাম রাইফেলসের ভূমিকা, অভিপ্রায় ও ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে বারবার বেপরোয়া ও ব্যর্থ অভিযোগ করছে। আসাম রাইফেলস ৩ মে-র পর থেকে মানুষের জীবন বাঁচানো ও শান্তি ফেরানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
সেনার তরফ থেকে আরো জানানো হয়েছে, মণিপুরের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। সেখানে গ্রাউন্ড লেভেলে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে কৌশলগত পর্যায়ে মতবিরোধ হতেই পারে। এরকম ক্ষেত্রে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হয় ও বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা হয়। সকলে মিলে মণিপুরে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে কাজ করছে।
এক কুকি নেতাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই আমরা করেছিলাম। আসাম রাইফেলসকে আপনারা সম্পূর্ণ সমর্থন করেন, আর মেইতেইরা কেন বিরোধ করে? তিনি বলেছিলেন, ‘আসাম রাইফেলসের ক্যাচলাইনটা একবার দেখবেন।’ সেটা হলো, ‘ফ্রেন্ডস অফ হিল পিপল’।
আমরা যখন ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের শহর মোরে-তে যাই, তার একদিন আগেই কুকি মেয়েদের সাথে আসাম রাইফেলসের বিশাল ঝামেলা হয়েছিল। কুকি মেয়েদের অভিযোগ ছিল, আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা তাদের হেনস্থা করেছে। মোরেতে কুকি নারীদের সংগঠনের প্রধান আনচিনকে প্রশ্ন করেছিলাম, তবে কি আপনারা চান, আসাম রাইফেলস চলে যাক? সাথে সাথে আনচিনের জবাব, ‘প্রশ্নই ওঠে না। আমরা চাই মণিপুরের কম্যান্ডোরা এখান থেকে চলে যাক। আমরা আসাম রাইফেলসের বিরুদ্ধে নই। মণিপুরের পুলিশ ও কম্যান্ডোর বিরুদ্ধে।’
নামপ্রকশে অনিচ্ছুক ইম্ফলের সাংবাদিকের অভিযোগ, ‘আসাম রাইফেলস কুকিদের সাহায্য করছে। তারা অনেকদিন মণিপুরের পাহাড়ে আছে। তাদের সরিয়ে দেয়া হোক। তাদের জায়গায় সেনার অন্য ব্রিগেড মোতায়েন করা হোক।’
আপনি মেইতেই ত্রাণশিবিরে যান। বিশেষ করে চূড়াচাঁদপুরের কাছে মৈরাঙের শিবিরে। সেখানে শুনবেন, আসাম রাইফেলস তাদের শিবিরে নিয়ে এসেছে। কোথাও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাড়ি করে মেইতেইদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছে তারা। মোরের কাছে কথা নামে মেইতেইদের গ্রাম আছে। চারদিকে কুকিরা, মাঝখানে এই একটা মেইতেই গ্রাম। আসাম রাইফেলস অনেক কষ্টে গ্রামটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। কিন্তু তারপরেও ত্রাণশিবিরে মেইতেইদের অভিযোগ, কুকিরা যখন তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, তখন আসাম রাইফেলস আসেনি, কিছুই করেনি।
আবার মোরেতে কুকিদের ত্রাণশিবিরে পুলিশের বিরুদ্ধে একই অভিয়োগ শুনেছি ঘরহারানো উদ্বাস্তু মানুষদের কাছে। তারাও বলেছেন, যখন তাদের ঘর জ্বলছিল, তখন পুলিশ কী করছিল`? তারা দীর্ঘ পথ জঙ্গলের মধ্যে পাড়ি দিয়ে অবশেষে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছেন। কিন্তু তাদের বাড়ি, টাকা, পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে সব খুইয়েছেন। তাদের অভিযোগ, পুলিশ কোনো মেইতেইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
মণিপুরে এই বিভাজনটা মারাত্মক। বিশেষ করে আসাম রাইফেলস ও রাজ্যের পুলিশকে নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা বড়ই চিন্তার।
সমাধান কোন পথে?
প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিধায়করা স্মারকলিপি দিয়ে যেসব ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে, তা মেইতেইদের দাবি। এই দাবির মধ্যে আছে এসওও চুক্তি বাতিল করা। ২০০৮ সালে এই চুক্তি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার, মণিপুর ও কুকিদের মধ্যে। চুক্তি অনুসারে কুকি গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে সেনা ও মণিপুরের পুলিশ কোনো অপারেশন করবে না। কুকি গোষ্ঠীগুলোও কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজ করবে না।
গত ১০ মার্চ মণিপুর সরকার জানিয়ে দিয়েছে, তারা কুকি ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) ও জোমি রেভলিউশনারি আর্মির ক্ষেত্রে এসওও থেকে সরে এসেছে। কারণ, এই গোষ্ঠীগুলো বেআইনিভাবে বনভূমি দখল করার আন্দোলনের সাথে যুক্ত। তারপরেও তারা কুকি গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে অপারেশন করতে পারছে না, কারণ পাহাড়ে তো আসাম রাইফেলস আছে। আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া মেইতেইদের বিরুদ্ধে তাদেরও কিছু করার নেই, কারণ, উপত্যকায় আছে পুলিশ ও কম্যান্ডোরা।
কুকিদের মধ্যে প্রায় ৩০টি গোষ্ঠী আছে যারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ৪০ বিধায়কের দাবি, অস্ত্র সমর্পন করতে হবে। এর আগেও বলেছি, অস্ত্র শুধু কোনো একপক্ষের হাতে নেই। দুই পক্ষের হাতেই প্রচুর ও অত্যাধুনিক অস্ত্র আছে। এই সঙ্ঘাতে সেইসব অস্ত্র ব্যবহারের ফলে এত মানুষ মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন। প্রশ্ন হলো, দুই পক্ষের হাত থেকে কী করে অস্ত্র নেয়া হবে? কোনো সমাধানসূত্র এক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত নেই।
কুকিদের প্রধান দাবি, তাদের জন্য আলাদা প্রশাসন করতে হবে। মেইতেইদের দাবি, এটা কিছুতেই করা যাবে না। এই সমস্যার কিভাবে সমাধান হবে? কোনো সমাধানসূত্র এখনো সামনে নেই।
কিভাবে ও কবে মাদক-সমস্যার সমাধান হবে, অনুপ্রবেশ নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করবেন না, জানা নেই। কবে উদ্বাস্তু মানুষরা ত্রাণশিবির থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন, জানা নেই। দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতা, বিদ্বেষ, সন্দেহ, অবিশ্বাস, লড়াইয়ের ইচ্ছে কবে কমবে সেটাও জানা নেই। এমনকি সরকার কবে সমাধানসূত্র নিয়ে আসতে পারবে, তাও জানা নেই মণিপুরের মেইতেই ও কুকিদের। তবে সবপক্ষ একসুরে একটা কথাই বলেছেন, পরিস্থিতি এত সহজে স্বাভাবিক হবে না। তার জন্য সময় লাগবে। কতদিন? এক বছর, পাঁচ বছর, ১০ বছর বা তারও বেশি? সত্যিই জানা নেই। সূত্র : ডয়চে ভেলে