বেলা ১২টা। নগরের বন্যাদুর্গত সুবহানীঘাট এলাকায় ঢুকতেই নাকে এলো দুর্গন্ধ। বিকট সে গন্ধ। এরইমধ্যে বসবাস করছে মানুষ। পানির রং কালচে হয়ে গেছে। সুয়ারেজ খালের সঙ্গে মিশে গেছে সড়কের পানি। এ কারণে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এলাকায়। মুখ চেপে ওই এলাকায় চলাচল করছেন মানুষজন। আর বাসা-বাড়িতে যারা আছেন তারা খুব কষ্টে আছেন। স্থানীয় সুমন আহমদ জানিয়েছেন- এলাকার কয়েকশ’ বাসার নিচতলায় পানি ঢুকেছে।
বাসা ছেড়ে অনেকেই চলে গেছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। এখন যারা আছেন তারা পড়েছেন নানা সংকটে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। স্থানীয় ব্যবসায়ী কেরামত মিয়া জানান- চারদিন ধরে এলাকায় পানি। বন্যার পানির সঙ্গে শুধু সুয়ারেজ খালই নয়, ড্রেনের ময়লাও এসে যুক্ত হয়েছে। এ কারণে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নগরের উপশহরের ডি বøক। ওই এলাকায়ও অন্তত ৫ শতাধিক বহুতল ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকেছে। অনেকের আসবাবপত্র ভিজে গেছে। একই এলাকার ই এবং এফ বøকেরও দৃশ্য একই। ওই এলাকার অন্তত ৩ শতাধিক বাসার নিচতলায় পানি ঢুকেছে। বেদনা বেগম নামের এক ভাড়াটে বাসিন্দা জানিয়েছেন- রাতে হঠাৎ করে পানি ঢুকে পড়ায় তার বাসার আসবাবপত্র ভিজে গেছে। সবকিছু রেখে পাশের বাসায় এসে ওঠেন। এখনো বাসা থেকে পানি না নামায় যেতে পারছেন না। আসবাবপত্র ভিজে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
চারদিনের মধ্যে শুধুমাত্র খিচুড়ি খেয়ে জীবন যাপন করছেন বলে জানান। জানান- গতকাল দুপুরের দিকে একবার বাসায় গিয়েছিলেন। বাসার ভেতরে পানি থাকায় তিনি কোনো মালামালই সরাতে পারছেন না। সাদাটিকর, কুশিঘাট এলাকায় এখনো পানি রয়েছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছে। দূরবর্তী এলাকা থেকে পানি নিয়ে আসছেন কলোনির বাসিন্দারা। তারা জানান- সিলেট সিটি করপোরেশন থেকে একদিন পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়া হয়েছিল। আর দেয়া হয়নি। এখন তারা দূরের টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে আসতে হচ্ছে। সিলেটে বন্যায় আক্রান্ত প্রায় ৫ হাজার মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। এখনো দুটি আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন ৫ শতাধিক মানুষ। তাদের বাড়িঘর সুরমা নদীর তীরবর্তী এলাকায়। দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে সিটি করপোরেশন থেকে খিচুড়ি রান্না করে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধিরা তাদের দেখভাল করছেন। তবে; বাসা বাড়িতে যারা পানিবন্দি রয়েছে তাদের দিকে তাকাচ্ছেন না কেউ। এখন পর্যন্ত বেসরকারি ত্রাণও আসেনি। সিলেট নগর ছাড়াও জেলার জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও ওসমানীনগরে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস গতকাল বিকালে জানিয়েছেন- সিলেট নগরে সুরমার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে; এখনো নগরের বহু এলাকায় পানি রয়েছে। জকিগঞ্জে অমলসীদ ও কানাইঘাটে সুরমার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি জানান- পানি কমছে। বৃষ্টি না হলে আরও পানি কমবে। বিভিন্ন এলাকায় ডুবে যাওয়া বাঁধ ভেসে উঠেছে। পানি নামার পর বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা হবে বলে জানান তিনি। এদিকে- জেলার বিভিন্ন উপজেলার বন্যা দুর্গত মানুষের মধ্যে খাদ্য সংকট চলছে। খোদ আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষজনও খাবার সংকটে রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের কাছে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পানি না নামায় গতকাল সকাল পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা আড়াইশ’ মানুষ বাড়ি ফিরেছে। সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে- দুটি পৌরসভাসহ জেলার ৬৮ ইউনিয়নের ৭৬১টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকেছে। বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৮০ হাজার। জেলা প্রশাসন থেকে ৫৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রয়েছে। বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৮০৬ জন মানুষ বসবাস করছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের ৯টি ওয়ার্ড, সদর উপজেলা, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। এদিকে- বন্যাকবলিত এলাকায় রোগ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষজন। তারা জানান- বর্তমানে ভাইরাস জ্বরে বেশি আক্রান্ত মানুষ। পানিবন্দি থাকার কারণে অনেকেই চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। তবে সিলেট জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মোজয় দত্ত জানিয়েছেন- সিলেট জেলায় ১৩১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। নৌকাযোগে এসব মেডিকেল টিমের সদস্যরা বন্যার্তদের মধ্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি উপজেলায় চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি একজন সার্বিক বিষয় মনিটরিং করছেন একজন ডাক্তার।
তিনি জানান- বন্যার কারণে রোগীর সংখ্যা এখনো বাড়েনি। পানি নামলে হয়তো রোগী বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
নগরে উন্নতি: সিলেট নগরীর বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। গতকাল সুরমা নদীর পানি বিপদসীমা থেকে নিচে নেমেছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। দুপুর ১২টায় বিপদসীমার নিচ দিয়ে সিলেটে সুরমার পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো। টানা বৃষ্টি না হলে পানি আরও কমবে বলে জানায় পাউবো। সিলেট নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ডে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ায় সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে বিভিন্নভাবে কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। সিসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর জানান, বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বেশির ভাগ এলাকার। তাছাড়া বন্যার ঝুঁকিতে আছে এমন সকল ওয়ার্ডে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পানি বাড়লে তাদের ওই আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হবে। সুরমা তীরবর্তী বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনগুলো রক্ষার জন্য বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ২৫ ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর তাকবিরুল ইসলাম পিন্টু ও রায়হান আহমদের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তিনি জানান, নগরীর ১৫নং ওয়ার্ডের কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী একটি ৫ তলা খালি ভবনে দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিসিকের স্বাস্থ্য শাখার একটি চিকিৎসক দল সেখানে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই দুটি আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যাকবলিত ওয়ার্ডগুলোতে শুকনা খাবার, চিঁড়া, মুড়ি, গুড়, বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওরস্যালাইন ও কিছু কিছু ওয়ার্ডে মোমবাতি সরবরাহ করা হয়েছে। গত শনিবার বিকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খিচুড়ি দেয়া হয়েছে।