হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রসুন মানুষের খাদ্যতালিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং এর ঔষধি গুণাগুণের কারণেও এটি জনপ্রিয়। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল (জীবাণুনাশক) ও অ্যান্টিভাইরাল (ভাইরাস প্রতিরোধী) হিসেবে রসুনকে প্রাচীনকাল থেকেই রান্না ও চিকিৎসায় অপরিহার্য উপাদান ধরা হয়।
এর উৎপত্তি মূলত এশিয়ায় হলেও অভিবাসনের মাধ্যমে রসুন ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ ও আমেরিকায়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রসুন উৎপাদক দেশ হলো চীন।
রান্নাঘরের অপরিহার্য উপাদান
বিশ্বের প্রায় সব রান্নাতেই রসুন একটি অপরিহার্য উপাদান। ড্যানিশ শেফ পল এরিক জেনসেন জানান, তিনি কখনো এমন কোনো শিক্ষার্থী দেখেননি যে রসুন চেনে না। তার মতে, রসুন খাবারের স্বাদ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি করে এবং ফরাসি রান্না রসুন ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।
তবে ১৯৭০-এর দশকের আগে ডেনমার্কে রসুন ছিল অনেকটাই অপরিচিত। তুর্কি শ্রমিকদের মাধ্যমে রসুনের ব্যবহার বাড়ে। বর্তমানে শেফ জেনসেন রসুনকে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসেবেও ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিন সকালে এক কাপ স্যুপ খাই, তাতে থাকে পিষে দেওয়া এক কোয়া রসুন। আমাদের সর্দি-কাশি বা ফ্লু হয় না—রসুনই এর কারণ।”
দাসদের পাতে থেকে রাজকীয় থালায়
রসুনের ইতিহাস শুধু রান্নার নয়, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্বেও সমৃদ্ধ। প্রাচীন গ্রীসে দেবী হেকাটির উদ্দেশ্যে রাস্তাচৌরায় রসুন উৎসর্গ করা হতো। মিশরের ফারাও তুতেনখামুনের সমাধিতেও রসুন পাওয়া গেছে—যা তাকে পরকালে রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করা হতো।
‘গার্লিক: অ্যান এডিবল বায়োগ্রাফি’ বইয়ের লেখক রবিন চেরির মতে, বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো রেসিপি—মেসোপটেমীয় এক স্ট্যু (৩,৫০০ বছর পুরোনো)—তাতেও ছিল রসুন। এমনকি প্রাচীন চিকিৎসাগ্রন্থ এবার্স প্যাপিরাস-এও রসুনের চিকিৎসা ব্যবহার বর্ণিত আছে, যা হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট ও পরজীবী সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো।
গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটাস, দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও লেখক অ্যারিস্টোফেনিসও রসুনের গুণাগুণের কথা উল্লেখ করেছেন। রোমান সৈন্যরা বিশ্বাস করতেন, রসুন তাদের শক্তি ও সাহস বাড়ায়—তাই যুদ্ধের সময় এটি খেতেন। এর মাধ্যমেই রসুন ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে দীর্ঘ সময় ধরে রসুনকে “গরিবদের খাবার” বলা হতো। মিশরের পিরামিড নির্মাণে নিযুক্ত দাসেরা বা রোমান নাবিকরা রসুন খেতেন শক্তি বাড়ানোর জন্য। রসুন ছিল সস্তা এবং দুর্গন্ধ ঢাকতে পারত বলে দরিদ্রদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ছিল।
নবজাগরণে ভাবমূর্তি বদল
রেনেসাঁ যুগে (১৪-১৬ শতক) রসুনের ভাবমূর্তি বদলাতে শুরু করে। ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরিকে রসুন দিয়ে ব্যাপটাইজ করা হয়েছিল—এরপর থেকেই এটি রাজপরিবারের খাবারেও জায়গা পায়। উনবিংশ শতকে ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে রসুন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রবিন চেরির ভাষায়, “একসময় ‘রসুনখেকো’ শব্দটি ইহুদি, ইতালীয় ও কোরিয়ানদের অবমাননা করতে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু আজ সেই রসুনই বিশ্বজুড়ে স্বাদ ও স্বাস্থ্যের প্রতীক।”
গুণাগুণ
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, রসুন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, কোলেস্টেরল কমায়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর।
একসময় দাসদের শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত এই রসুন এখন রাজকীয় পাতে এবং আধুনিক চিকিৎসার আলোচনায় সমানভাবে স্থান দখল করে আছে।




