বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব। এর আগে কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি দেশের ছাত্ররাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন সময়ের আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি রফিক রাফি
সময়ের আলো : জুলাই আন্দোলনে ছাত্রদল না শিবিরের ভূমিকা বেশি ছিল?
রাকিবুল ইসলাম রাকিব : এখন শিবির দাবি করতেই পারে, কারণ তারা তো গুপ্ত সংগঠন। তারা যদি বলে ছাত্রলীগের সব (নেতা) তাদের ছিল, সেটি তারা দাবি করতে পারে। ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি পদে থেকে ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রদলের ভূমিকার ধারেকাছেও শিবির নেই। জুলাই-আগস্টে যে মামলাগুলো হয়েছে সেটি এনালাইসিস করলে বোঝা যাবে কারা ভূমিকা রেখেছে এবং কারা ভুক্তভোগী। সারা দেশে ছাত্রদলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে। তারা মাঠে নামার কারণেই মামলা খেয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে। এখন জুলাই-আগস্ট সফল না হলে শিবিরের কার নামে মামলা হতো? কে ভুক্তভোগী হতো? কিন্তু ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জেলখানা থেকে বের হতে পারত কি না সন্দেহ। কারণ সবার পদ রয়েছে। তারা পদে থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
আগামী দিনে ছাত্রদলের রাজনীতি কী রকম হবে? সবকিছু কি পুরোনো ধাঁচেই চলবে? এ নিয়ে তারেক রহমানের নির্দেশনা কী?
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাত্রদলের সরাসরি অভিভাবক। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা আলোচনা করে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ধারার রাজনীতি উপহার দিয়ে যাচ্ছি। ক্যাম্পাসে ব্যক্তিগত শোডাউন নেই। প্রভাব-প্রতিপত্তিমূলক শোডাউন নেই। সাধারণ ছাত্রদের জন্য যে রাজনীতি সেটি করার চেষ্টা আমরা করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি কর্মসূচিও ছাত্রদলের লাভের জন্য পালন করা হয়নি। ছাত্রলীগ ইস্যু, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে শিক্ষাবান্ধব কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। এখন বাইক শোডাউন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হলগুলোতে রাজনৈতিক চর্চা করছি না, মধুর ক্যান্টিনে গেছি কি না, একদম দৃশ্যমান ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতি ইতিমধ্যে ছাত্রদল উপহার দিয়েছে। সহিংস রাজনীতি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে। তার প্রমাণ আমরা গত ৯ মাসে দিয়েছি। এটি বজায় রাখতে পারলে সাধারণ ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতিকে আরও ইতিবাচকভাবে নেবে। যেই সংগঠন পছন্দ হবে, সেই সংগঠন করবে। দুয়েকটা ঘটনা দিয়ে পুরো বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিতর্কিত করা সম্ভব না। আগামীতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু সেটি আমরা ওন করি কি না এটি হলো ফ্যাক্ট। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ছাত্রদল রাজনীতি করে যাচ্ছে।
ছাত্রদল কেন করেন?
আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমার উপজেলার যারা ছাত্রদল করতেন এবং আমার বড় ভাই যিনি আমার অভিভাবক ও শিক্ষক তার বন্ধু সার্কেলের অনেকেই ছাত্রদল করতেন। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলায় তারা স্মার্টলি রাজনীতি ডিল করতেন। তারা সে সময় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাদের দেখে আমার রাজনীতিতে আসা। ছোট থেকেই পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল। সেখানে ঢাবি, মধুর ক্যান্টিন ও ছাত্ররাজনীতি, নব্বইয়ের ইতিহাস নিয়ে লেখাগুলো পড়তাম। এগুলোতে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি ছাত্ররাজনীতিতে আসি। পরবর্তীতে এইচএসসি মুক্তাগাছার শহিদ স্মৃতি কলেজে ভর্তি হই। সেখানে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের রাজনীতির মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। সেখানে বিজ্ঞান বিভাগে আমি নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকা অপরিসীম। ছাত্র নেতৃত্ব থেকে জাতীয় নেতৃত্বের দিকে যায়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আমি অনেক ধাপ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছি। আমার এখন পূর্ণ মনোযোগ ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। আমি যখন ঢাবির আহ্বায়ক ছিলাম তখন এক ধরনের বাস্তবতা ছিল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলা, পুলিশের হামলা-মামলা, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। বাসায় রেইড দিয়েছে, আড্ডা দিতে পারতাম না। আমার বাসা থেকে আমাকে গ্রেফতার করেছে। পরবর্তীতে যখন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের দায়িত্ব পাই, তখনও খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনটাই সবসময় মাথায় ছিল। জুলাই-আগস্টের পরের বাস্তবতায় এখন আমার মূল দায়িত্ব সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রপাগান্ডা মোকাবিলা করা। ছাত্রদল যে সততা-নীতি নিয়ে ছাত্ররাজনীতি করে সভাপতি হিসেবে সেটি প্রমাণের দায় আমার রয়েছে। ছাত্রদলকে একটি শক্তিশালী অবস্থায় রেখে আমি বিদায় নিতে চাই। এই পদে থেকে এখনও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। এটি সম্পূর্ণ দলের ওপর নির্ভর করবে। দল যে সিদ্ধান্ত দেবে তা আমি মেনে নেব।
আওয়ামী আমলে আপনার ওপর নির্যাতনের মাত্রা কেমন ছিল? মামলা কতগুলো ছিল?
আমার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫৬টি মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে। অধিকাংশেরই চার্জশিট হয়ে গেছে। জেলে গেছি পাঁচবার। এই পাঁচবারে এক বছরের মতো জেল খাটতে হয়েছে।
শিবিরের সঙ্গে আপনাদের পলিটিক্যাল লিয়াজোঁ ছিল ১২ বছর। কিন্তু সম্প্রতি ছাত্রদল-শিবির মুখোমুখি অবস্থানে। দূরত্বও বেড়েছে। এর পেছনের কারণ কী?
শিবিরের সঙ্গে আমাদের কখনো জোট বা আদর্শিক জোট ছিল না। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির একটি নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক জোট ছিল। শিবিরের সঙ্গে সবসময় আমাদের একটা দূরত্ব ছিল। এখানে মূল সমস্যাটা হলো, তারা প্রকাশ্য রাজনীতি করতে চায় না। সাধারণ ছাত্রদের মাঝে থেকে ছোট ছোট ইস্যুকে তারা বড় করে। এটি করে ছাত্ররাজনীতিকে বিভ্রান্ত করা হয়। তারা জুলাই-আগস্টের পর থেকে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে একটা অবস্থা দাঁড় করাতে চায়। যতদিন তাদের এই ধারণা বজায় থাকবে ততদিন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব থাকবে।
প্রাইমএশিয়ার ছাত্র পারভেজ মারা গেছে প্রেম-ভালোবাসাকেন্দ্রিক ব্যক্তিগত ইস্যুতে। তা হলে এটিকে পলিটিক্যাল ইস্যু করা হচ্ছে কেন?
এটি নারীঘটিত বিষয় এমন না। দুজন শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ্য করে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসিকে কেন্দ্র করে ঘটনাটি হয়েছে, তারা এটি বলেছে। এ রকম একটি তুচ্ছ বিষয়ে একা পেয়ে হুমকি দিয়ে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তারা আগেই বলেছে ১০ থেকে ১৫টি লাশ ফেলে দেবে। এই জোরটা তারা কোথায় পেয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ব্যানার থেকে পেয়েছে। ঢাকা শহরে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে কি এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে? তাদের (বৈষম্যবিরোধী) এটি স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের অপরাধ রয়েছে। সে (বৈষম্যবিরোধী নেতা) উপস্থিত ছিল। তারা এটিকে যেভাবে ডিফেন্ড করছে, তাতে অপরাধকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ছাত্রদলের কেউ অপরাধ করলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই, নিচ্ছি। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের কেউ অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী তার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু নাটোরে ছাত্রলীগের একজনকে রিকশায় ঘোরানোর কারণে ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দিয়েছি। আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। কিন্তু অন্য সংগঠন তাদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি সাহস বলেছে, ‘তথাকথিত জুলাই আন্দোলন’। এ ব্যাপারে আপনাদের সাংগঠনিক অবস্থান কী?
তার পুরো বক্তব্য শুনলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। সে জানিয়েছে, অনাকাক্সিক্ষতভাবে এটি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বক্তব্য সে পরিষ্কার করেছে যে, অসাবধানতাবশত, অসতর্কতাবশত এটি হয়েছে। তার জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করেছে। এটি সংগঠনের বক্তব্য না, তার ব্যক্তিগত বক্তব্য।
যে ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছেন, তাদের সঙ্গে আপনাদের দূরত্ব বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে?
আমি বিশ্বাস করি, সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে কখনোই দূরত্ব ছিল না। আমি যতদিন রয়েছি এবং আগামীতেও ছাত্রদের সঙ্গে দূরত্ব হবে না। কারণ ছাত্রদলের ইতিহাসে বাংলাদেশ ও রাষ্ট্রবিরোধী ফ্যাসিস্টের মতো করে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে কখনো অবস্থান নেয়নি। হয়তো ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ছিল, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। সেগুলো করতে গিয়ে নানা বিষয় উঠে এসেছে। সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন, কিন্তু বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য, বিতর্কিত করার জন্য ফ্যাসিবাদ কায়েম করার জন্য, ভোট চুরি করার জন্য কখনো ছাত্রদল ভূমিকা পালন করেনি।
ছাত্রদলের অভ্যন্তরে মাঝেমধ্যেই মতপার্থক্য, গ্রুপিং ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের অভিযোগ শোনা যায়। তৃণমূলে ঐক্যের এই সংকট কীভাবে সমাধান করবেন?
অতীতে যখন ছাত্রলীগের সাদ্দাম-ইনান ছিল, তারা কোনো ঘটনা ঘটলেই বলে দিত এটি ছাত্রদলের গ্রুপিং। গত ৯ মাসে আমরা প্রমাণ করেছি আমাদের কোনো গ্রুপিং নেই। প্রতিযোগিতা রয়েছে। সেটিও দৃশ্যমান নয়।
আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ রাজপথে নেমে মিছিল করছে। এ ব্যাপারে ছাত্রদলের অবস্থান কী?
এর জন্য পুরোপুরি দায় নিতে হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে এবং অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা দুই উপদেষ্টাসহ জুলাই আন্দোলন পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারে থেকে অথবা বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োগ পেয়ে যারা সুফল ভোগ করছে, তাদের দায় বহন করতে হবে। তাদের এদিকে এখন আর মনোযোগ নেই। একটি জায়গায় রয়েছে, ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারলে সেই নেতাকর্মীগুলো তাদের দলে যোগ দেবে। এ চিন্তায় তারা রয়েছে। এই চিন্তা থাকলে কখনোই আওয়ামী লীগের মিছিল বন্ধ করতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে যারা অগ্রভাগে ছিল, তাদের আমরা সহযোগিতা করেছি। আমার মনে হয় বর্তমান সরকার যদি কোনো ভুল না করে এবং বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে যে দল গঠন করেছে ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য বা ক্ষমতার কাছে রাখার জন্য যদি তারা কোনো ঐতিহাসিক ভুল না করে তা হলে এ দেশে আওয়ামী লীগের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।